পদত্যাগী আওয়ামী লীগ সরকারের আমলে পুলিশের পদোন্নতিতে নজিরবিহীন দুর্নীতি হয়েছে। ১৭১ কর্মকর্তা ১৯৯৭ সালে চাকরিতে যোগ দিয়েছেন। কিন্তু ছয় বছর আগে অর্থাৎ ১৯৯১ সালে তাদের চাকরিতে যোগদান দেখিয়ে পদোন্নতি দেওয়া হয়েছে। এক্ষেত্রে জ্যেষ্ঠ ৭৫০ কর্মকর্তাকে ডিঙিয়ে (সুপারিসড) কনিষ্ঠ ১৭১ জনকে পুলিশ পরিদর্শক পদে পদোন্নতি দেওয়া হয়। পরে তাদের অনেকেই পদোন্নতি পেয়ে সহকারী পুলিশ সুপারও (এএসপি) হয়েছেন।
রাজনৈতিক বিবেচনায় দেওয়া এই পদোন্নতিতে সব মিলে বঞ্চিত হয়েছেন ২২৫০ কর্মকর্তা। এর নেপথ্যে ছিলেন সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার তৎকালীন সংস্থাপন ও প্রশাসনবিষয়ক উপদেষ্টা এইচটি ইমাম।
বিধিবহির্ভূতভাবে পদোন্নতিপ্রাপ্ত ওই ১৭১ কর্মকর্তার জ্যেষ্ঠতা বাতিলের দাবি জানিয়েছেন বঞ্চিতরা। বিষয়টি নিয়ে স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টা লে. জেনারেল জাহাঙ্গীর আলম চৌধুরী ও আইজিপি ময়নুল ইসলামের হস্তক্ষেপ কামনা করেছেন। সোমবার তারা উপদেষ্টা ও আইজিপির সঙ্গে দেখা করে লিখিত আবেদন জানিয়েছেন।
পুলিশ কর্মকর্তারা জানান, ১৮৬১ সালের পুলিশ আইন এবং বাংলাদেশ পুলিশ প্রবিধান (পিআরবি) অনুসারে পুলিশ বিভাগে পদোন্নতিসহ সব কার্যক্রম পরিচালিত হয়। ১৭১ জনের পদোন্নতির নির্বাহী আদেশ পুলিশ বিভাগের অভ্যন্তরীণ নীতিমালার সম্পূর্ণ পরিপন্থি। এটি অবাস্তব ও বিভাগীয় নিয়মনীতির পরিপন্থি। দুর্নীতির মাধ্যমে এ ধরনের পদক্ষেপ নেওয়া হয়েছে। তাই আদেশটি বাতিলযোগ্য। এ আদেশ কোনোভাবেই গ্রহণযোগ্য হতে পারে না।
এ বিষয়ে জানতে চাইলে মঙ্গলবার সন্ধ্যায় স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টা লে. জেনারেল জাহাঙ্গীর আলম চৌধুরী যুগান্তরকে বলেন, এই মুহূর্তে আমি একটু বাসায় বিশ্রামে আছি। বিষয়টি নিয়ে পরে অফিস টাইমে কথা বলা যাবে।
এ প্রসঙ্গে টিআইবির নির্বাহী পরিচালক ড. ইফতেখারুজ্জামান মঙ্গলবার যুগান্তরকে বলেন, যে প্রক্রিয়ায় ১৭১ জনকে পদোন্নতি দেওয়া হয়েছে সেটা ক্ষমতার অপব্যবহার এবং দুর্নীতি। এক্ষেত্রে দলীয় রাজনীতির ওপর ভিত্তি করে যে পদক্ষেপগুলো নেওয়া হয়েছে প্রকারান্তরে এটা যে দুর্নীতি তা অস্বীকার করার উপায় নেই। যেসব অনিয়মের কারণে ১৯৯১ সালে তাদের নিয়োগ বাতিল করা হয়, সেগুলো সুষ্ঠু তদন্ত হয়েছে কি না, তা একটি বড় বিষয়। যদি না হয়ে থাকে তবে সেটা আরও একদফা স্বজনপ্রীতি। তিনি বলেন, পুরো বিষয়টি খতিয়ে দেখা দরকার।
সূত্র জানায়, ১৯৯১ সালে এসআই হিসাবে ওই ১৭১ কর্মকর্তার নিয়োগ প্রক্রিয়াধীন অবস্থায় বাতিল হয়ে যায়। অনিয়মের কারণে প্রক্রিয়াটি বাতিল হয়ে যায়। এর ছয় বছর পর ১৯৯৭ সালে তারা চাকরি পান। এর আগে ১৯৯২ থেকে ১৯৯৬ সাল পর্যন্ত বিভিন্ন ব্যাচে ৭৫০ জনকে এসআই হিসাবে নিয়োগ দেওয়া হয়।
পিআরবি প্রবিধান অনুযায়ী এই ৭৫০ এসআই ১৯৯৭ সালে নিয়োগপ্রাপ্ত ১৭১ এসআই’র চেয়ে জ্যেষ্ঠ। কিন্তু সরকারের নির্বাহী আদেশে ১৯৯৭ সালে নিয়োগপ্রাপ্ত ১৭১ কর্মকর্তাকে আওয়ামী লীগের সূর্যসন্তান উল্লেখ করে সিনিয়রিটি দেওয়া হয়েছে। এতে ১৯৯২ থেকে ১৯৯৬ সাল পর্যন্ত নিয়োগপ্রাপ্ত ৭৫০ কর্মকর্তা তাদের পেছনে পড়ে যান।
যুগান্তর হতে জানা যায়, এ নিয়ে বিভিন্ন সময়ে বঞ্চিতরা ক্ষোভ প্রকাশ করলেও সমস্যার সমাধান হয়নি। এরই মধ্যে বঞ্চিতদের বেশ কয়েকজন অবসরে চলে গেছেন। দুই মাস আগে অবসরে যাওয়া এক পুলিশ পরিদর্শক শাহ মো. মঞ্জুর কাদের যুগান্তরকে বলেন, সরকার চাইলে আমাদেরও ভূতাপেক্ষা পদোন্নতি দিতে পারে। এটা হলেও মানসিকভাবে কিছুটা সান্ত্বনা পেতাম। অপরদিকে বঞ্চিত যারা এখনো কর্মরত অছেন তারা বিধি মোতাবেক জ্যেষ্ঠতা দাবি করছেন।
এ বিষয়ে পুলিশের আইজি ময়নুল ইসলাম যুগান্তরকে বলেন, গত কয়েক বছরে বঞ্চিত অনেকেই বিভিন্ন দাবি-দাওয়া নিয়ে আমাদের কাছে আসছেন। কাউকেই আমরা মানা করছি না। আবার তাৎক্ষণিকভাবে সবকিছুর সমাধান করাও সম্ভব হচ্ছে না। তবে যারাই আমাদের কাছে আসছেন, তাদের সবার দাবিকেই গুরুত্ব দেওয়া হচ্ছে। সে অনুযায়ী যথাযথ ব্যবস্থা নিতে আমাদের কার্যক্রম চলমান।
স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টার কাছে দেওয়া এক আবেদনে বঞ্চিতরা উল্লেখ করেন, আমরা ১৯৯২, ১৯৯৩, ১৯৯৪ ও ১৯৯৫ সালে সরাসরি এসআই পদে যোগদান করি।
পিআরবি ৭৪১ ও ৭৪২ প্রবিধান অনুযায়ী, এসআই পদে নিয়োগের ক্ষেত্রে প্রাথমিক স্বাস্থ্য পরীক্ষা, লিখিত পরীক্ষা, ভাইভা ও চূড়ান্ত স্বাস্থ্য পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হতে হয়। পরে পুলিশ ভেরিফিকেশন শেষে পুলিশ একাডেমি সারদায় এক বছরের মৌলিক পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হতে হয়। উত্তীর্ণদের শিক্ষানবিশ এসআই হিসাবে নিয়োগ দেন সারদার পুলিশ একাডেমি প্রিন্সিপাল। শিক্ষানবিশ হিসাবে দুই বছর দায়িত্ব পালনের পর তাদের চাকরি স্থায়ী হয়।
১৭১ জনের পদোন্নতিকে অবৈধ উল্লেখ করে আবেদনে বলা হয়, ১৯৯১ সালে প্রবিধানের আলোকে এসআই পদে নিয়োগ বিজ্ঞপ্তি প্রকাশ করা হয়। সে অনুযায়ী প্রাথমিক স্বাস্থ্য পরীক্ষা, লিখিত পরীক্ষা ও ভাইভা অনুষ্ঠিত হয়। কিন্তু অনিয়ম দেখা দেওয়ায় সেই নিয়োগ প্রক্রিয়া বাতিল করা হয়। সংক্ষুব্ধরা উচ্চ আদালতে মামলা করলে তা খারিজ হয়ে যায়।
পরে ধারাবাহিকভাবে ১৯৯২, ১৯৯৩, ১৯৯৪ ও ১৯৯৫ সালে বিধি মোতাবেক ৭৫০ জনকে এসআই পদে নিয়োগ দেওয়া হয়। ১৯৯৬ সালে সরকার পরিবর্তন হওয়ার পর ১৯৯১ সালে বাতিল ব্যাচের ১৭১ জন এসআই পদে চাকরির জন্য সরকারের কাছে আবেদন করেন। এর পরিপ্রেক্ষিতে ১৯৯৭ সালে তাদের অসমাপ্ত চূড়ান্ত শারীরিক পরীক্ষা সম্পন্ন করা হয়। এরপর তাদের পুলিশ ভেরিফিকেশন হয়। ভেরিফিকেশন শেষে তারা পুলিশ একাডেমি সারদায় এক বছরের মৌলিক প্রশিক্ষণ গ্রহণ করেন।
সে অনুযায়ী ১৯৯৮ সালের ১৩ অক্টোবর তারা শিক্ষানবিশ এসআই হিসাবে নিয়োগ পান। তাই কোনোভাবেই তারা ১৯৯২ থেকে ১৯৯৬ সাল পর্যন্ত নিয়োগপ্রাপ্তদের সিনিয়র হতে পারেন না। কিন্তু ২০১০ সালে শুধু রাজনৈতিক বিবেচনায় তৎকালীন প্রধানমন্ত্রীর বিতর্কিত উপদেষ্টা এইচটি ইমামের ডিও লেটারের পরিপ্রেক্ষিতে ১৯৯২ থেকে ১৯৯৬ সাল পর্যন্ত সময়ে নিয়োগপ্রাপ্তদের শিক্ষানবশি ঘোষণার একদিন আগে তাদের (১৯৯৮ সালের ১৩ অক্টোবর যোগদান করা) জ্যেষ্ঠতা দেওয়া হয়। এ ক্ষেত্রে পিআরবি লঙ্ঘন করে চারটি ব্যাচের ৭৫০ জনকে ডিঙানো হয়। জ্যেষ্ঠতাপ্রাপ্ত ১৭১ জনকে আওয়ামী লীগের সূর্যসন্তান হিসাবে উল্লেখ করা হলেও ৭৫০ জনকে বলা হয় ভিন্নমতাবলম্বী।
সাজ্জাদ হোসেন নামের এক বঞ্চিত কর্মকর্তা যুগান্তরকে বলেন, সিনিয়রদের ডিঙিয়ে ১৭১ জন জুনিয়র কর্মকর্তাকে পদোন্নতি দেওয়ার কারণে শুধু ১৯৯২ থেকে ১৯৯৬ সাল পর্যন্ত সরাসরি নিয়োগপ্রাপ্ত ৭৫০ এসআই-ই বঞ্চিত হননি। বঞ্চিত হয়েছেন বিভাগীয় পদোন্নতিপ্রাপ্ত আরও ১৫০০ পরিদর্শক। তাই ওই ১৭১ জনের জ্যেষ্ঠতা প্রদানের নির্বাহী আদেশ বাতিলের দাবি জানাচ্ছি।
পাশাপাশি নির্বাহী আদেশে পরিদর্শক পদে পদোন্নতি পাওয়া যেসব কর্মকর্তা পরে এএসপি পদে পদোন্নতি পেয়েছেন তাদের পদোন্নতির আদেশ বাতিলের দাবি জানাচ্ছি। বিধি মোতাবেক জ্যেষ্ঠতার ধারাবাহিকতা অনুসরণ করলে কর্মক্ষেত্রে শৃঙ্খলা আসার পাশাপাশি দীর্ঘদিন ধরে বঞ্চিত কর্মকর্তাদের হতাশা দূর হবে বলে তিনি জানান।
এদিকে রাজনৈতিক পটপরিবর্তনের পর বঞ্চিত পুলিশ কর্মকর্তারা অধিকমাত্রায় তৎপর হলেও এতদিন তারা একেবারে বসে ছিলেন না। নানা সময়ে ঊর্ধ্বতনদের কাছে নিজেদের বঞ্চনার কথা জানালেও সুফল আসেনি। ২০২১ সালের ১৫ সেপ্টেম্বর স্পেশাল ব্রাঞ্চে (এসবি) কর্মরত এক বঞ্চিত পুলিশ কর্মকর্তা আইজিপি ড. বেনজীর আহমেদের কাছে চিঠি দেন।
১৯৯২ সালে সরাসরি এসআই পদে যোগদানকারী কর্মকর্তাদের পক্ষে তার লেখা চিঠিতে বলা হয়-‘এএসপি পদে পদোন্নতির তালিকায় ১৯৯৭ ব্যাচের ৩৬ জন কর্মকর্তার নাম রয়েছে। অথচ ওই তালিকায় ১৯৯২ থেকে ১৯৯৬ সালে বিভিন্ন ব্যাচে নিয়োগপ্রাপ্ত কর্মকর্তাদের নাম নেই। কয়েক বছরের জুনিয়র কর্মকর্তাদের পদোন্নতির জন্য বিবেচনা করা হচ্ছে-তারা আমাদের অধীনে পিএসআই হিসাবে কর্মরত ছিলেন। তারা এখন এএসপি হলে তাদের জুনিয়র হয়ে আমাদের চাকরি করতে হবে। তখন আমাদের হৃদয়ে রক্তক্ষরণ হবে এবং হীনম্মন্যতায় ভোগা ছাড়া আর কিছুই থাকবে না। নিজের পরিবারের কাছেও মনের দিক থেকে ছোট হয়ে থাকতে হবে। বিষয়টি আমাদের জন্য শেষ বয়সে অনেক পীড়াদায়ক। তাই তালিকা থেকে ১৯৯৭ ব্যাচের সদস্যদের বাদ দিয়ে নিয়ম অনুসারে পদোন্নতির ব্যবস্থা করা হোক। অন্যথায় আমরা চাকরি থেকে বাধ্যতামূলক অবসর নিতে বাধ্য হব।’