‘শুইবার খাটের এক অংশ ভাঙা, আরেক অংশে কোনোমতে চেপে বসে আছি। খাটের সামান্য একটু জায়গায় কষ্ট করে ঘুমাই। তোশক ভিজা, বালিশ ভিজা। অবস্থা খুবই খারাপ। এভাবে কি ঘুম আসে ভাই।’ এভাবেই কান্নাজড়িত কণ্ঠে কথাগুলো বলেন লক্ষ্মীপুরের পানিবন্দি ষাটোর্ধ্ব নারী ফিরোজা বেগম।
প্রায় ১৮ থেকে ২০ দিন পরিবারসহ পানিবন্দি তিনি। দীর্ঘ সময় পানিবন্দি থাকায় চলাফেরা, রান্নাবান্না, খাওয়া-দাওয়া, পয়ঃনিষ্কাশন, সুপেয় পানির অভাব, রোগবালাই এবং চরম অর্থকষ্টে তাদের পরিবার।
ফিরোজার সত্তরোর্ধ্ব স্বামী আলী আকবর পেশায় একজন কৃষক। ইনকাম এখন একেবারে নেই।
বৃদ্ধ এ দম্পতির বাড়ি লক্ষ্মীপুর সদর উপজেলার দিঘলি ইউনিয়নের পশ্চিম জামিরতলী গ্রামে। তাদের বসতঘরে হাঁটু পানি, আর ঘরের চারপাশেই কোমর পানি। মান্দারী-দিঘলি আঞ্চলিক সড়ক থেকে তাদের বাড়িটি কিছুটা দূরে। সড়ক থেকে বাড়ি পর্যন্ত কোমর সমান পানি। বন্যা কবলিত এ দম্পতি এখন চরম দুর্দশাগ্রস্ত।
বুধবার (২৮ আগস্ট) সন্ধ্যায় বৃদ্ধ এ দম্পতির বাড়িতে গিয়ে করুণ চিত্র দেখা গেছে। তাদের আশপাশের লোকজন আশ্রয়কেন্দ্রে উঠলেও তারা রয়ে গেছেন বাড়িতেই।
সরেজমিনে দেখা যায়, বৃদ্ধা এ নারী বসে আছেন একটি চৌকিতে। ঘরের ভেতরে এবং আশপাশের অথৈ পানি। পানির মধ্যে থাকা একটি চৌকিতে বসে আছেন ফিরোজা।
ফিরোজা বেগম বলেন, খাওয়া-দাওয়া নিয়ে অনেক কষ্টে আছি আমরা। রান্নার কাজ কীভাবে হয়, জানতে চাইলে পাশেই থাকা টেবিলের ওপর একটি গ্যাসের চুলা দেখিয়ে বলেন, এ চুলাতে কোনোরকমে একটু রান্না করি। চিড়ামুড়ি খেয়ে কাটাই। ত্রাণ হিসেবে যা দিয়েছে, একটু খেয়ে জান বাঁচাই।
বৃদ্ধা যে চৌকিতে বসে আছেন, সে চৌকি ছুঁই ছুঁই করছে পানি। যে কোনো সময় চৌকিতে পানি উঠে যাবে। তখন চৌকির এক কোণেও বসে থাকার মতো ব্যবস্থা হয়তো থাকবে না।
তিনি বলেন, ইট দিয়ে চৌকি উঁচু করে রেখেছি। ঘরে আরও দুটি চৌকি আছে, সেগুলো পানির নিচে। এ চৌকিটা শুধু ইট দিয়ে উঁচু করে নিয়েছি। চারদিকে শুধু পানি আর পানি, কিন্তু খাবার পানির সংকট তাদের।
গৃহস্থ এ পরিবারের অনেক হাঁস-মুরগি ছিল। কিন্তু বন্যার পানিতে ক্ষতিগ্রস্ত হয়ে মারা গেছে বেশ কিছু মুরগি।
বৃদ্ধা বলেন, অনেক হাঁস-মুরগি ছিল, হঠাৎ পানি এসে ডুবে মারা গেছে সব। কয়েকটা হাঁস আছে। কলা গাছের ভেলাতে কোনোরকমে তাদের আশ্রয় দিতে পেরেছি। খাবার ঠিকমতো দিতে পারি না। নিজেদের খাবারই জুটে না আবার হাঁস-মুরগির খাবার। নিজের পেট নিয়েই টানাটানি। ৩টা গরু আছে, কম পানির সময় পাশের বাড়িতে রেখেছি। পানি বেশি হওয়ার সড়কের পাশের একটি জায়গায় রেখে দিই।
ফিরোজার স্বামী বৃদ্ধ আলী আকবর বলেন, ঘরে আমার বৃদ্ধা স্ত্রী আর ছেলে থাকে। রাস্তার পাশে গরু রাখা আছে, রাতে গরু পাহারা দিতে হয়। তাই আমি গরুর পাশেই থাকি। দিনে-রাতে মিলিয়ে বেশ কয়েকবার কোমর পানি মাড়িয়ে বাড়িতে আসা-যাওয়া করতে হয়। খুবই কষ্ট হচ্ছে, কিন্তু কিছু করার তো নেই। আয়-ইনকামও নেই। গরুর বাছুর আছে, দুধ বিক্রি করে কিছু টাকা পেতাম। কিন্তু এখন তো গরুকেই খাওয়াতে পারি না, দুধ দিবে কীভাবে?
লক্ষ্মীপুরে পানিবন্দি লোকজনের সংখ্যাও দিন দিন বাড়ছে। কেউ কেউ আশ্রয়কেন্দ্রে উঠলেও বেশিরভাগ মানুষ বাড়ি-ঘর ছেড়ে আশ্রয় কেন্দ্রে উঠতে অনাগ্রহী। চরম দুঃখ-কষ্ট নিয়ে বসবাস করছে এ জেলার ৫টি উপজেলার বন্যাকবলিত এলাকার বাসিন্দারা। জেলার প্রায় ৯০ শতাংশের বেশি এলাকা এখনো পানির নিচে তলিয়ে আছে।