বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের প্রেক্ষিতে শেখ হাসিনা সরকারের পতনের পর সারাদেশে বিভিন্ন পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য, উপ-উপাচার্যসহ প্রশাসনিক দায়িত্বে থাকা অনেকেই পদত্যাগ করেছেন। এর মধ্যে মাওলানা ভাসানী বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয় (মাভাবিপ্রবি) অন্যতম।
সরকার পতনের দিনই বিশ্ববিদ্যালয়টির সাবেক উপাচার্য অধ্যাপক ড. মো. ফরহাদ হোসেন পদত্যাগ করেন। একইসঙ্গে প্রক্টরসহ প্রশাসনের অনেকেই ইতিমধ্যে পদত্যাগ করেছেন।
বিশ্ববিদ্যালয়গুলোকে গতিশীল করার লক্ষ্যে এরইমধ্যে কয়েকটি বিশ্ববিদ্যালয়ে উপাচার্য নিয়োগ দিয়েছে অন্তর্বর্তীকালীন সরকার। অনান্য বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতেও উপাচার্য নিয়োগ প্রক্রিয়া চলমান। এরই ধারাবাহিকতায় মাভাবিপ্রবির শীর্ষ পদটিতে কে নিয়োগ পেতে যাচ্ছেন, তা নিয়ে চলছে নানা আলোচনা।
জানা গেছে, প্রত্যেক বিশ্ববিদ্যালয় থেকে সিনিয়র শিক্ষকদের তথ্য নিচ্ছে সরকার। এ ক্ষেত্রে গত আওয়ামী রাজনীতির সঙ্গে সংশ্লিষ্টতা ছিল কি না, শিক্ষার্থীদের আন্দোলনে কেমন ভূমিকা ছিল এবং একাডেমিকভাবে কতটা যোগ্যতাসম্পন্ন সেই বিষয়গুলি দেখা হচ্ছে।
মাভাবিপ্রবি প্রশাসন বলছে, নির্দেশনার প্রেক্ষিতে ইতিমধ্যে সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়কে প্রথম ও দ্বিতীয় গ্রেডপ্রাপ্ত শিক্ষকদের তথ্য প্রদান করা হয়েছে। যদিও বিশ্ববিদ্যালয়টি প্রতিষ্ঠার দুইযুগ পেরিয়ে গেলেও এখনও অভ্যন্তরীণ কোনো শিক্ষককে ভিসি হিসেবে নিয়োগ দেওয়া হয়নি।
তবে যেহেতু বিশ্ববিদ্যালয়টিতে দুইদশকের বেশি শিক্ষকতায় থাকা এবং প্রথম গ্রেডপ্রাপ্ত তিনজন শিক্ষক রয়েছেন তাই তাদের মধ্য থেকে ভিসি নিয়োগের সম্ভাবনাও রয়েছে।
বিশ্ববিদ্যালয়টির শিক্ষার্থীরা জানান, মাভাবিপ্রবির সার্বিক উন্নতি, গবেষণা বৃদ্ধি এবং শিক্ষার্থীবান্ধব অভিভাবক চান তারা। এ জন্য তাদের দাবি, নিজ ক্যাম্পাস থেকেই আসুক বিশ্ববিদ্যালয়ের সর্বোচ্চ পদটির কর্তা।
উপাচার্য হিসেবে আলোচনায় যারা
মাভাবিপ্রবির ভিসি হওয়ার দৌড়ে সবথেকে এগিয়ে রয়েছেন প্রথম গ্রেডভুক্ত তিনজন শিক্ষক। এর মধ্যে রয়েছেন—কম্পিউটার সায়েন্স অ্যান্ড ইঞ্জিনিয়ারিং (সিএসই) বিভাগের অধ্যাপক ড. মো. মতিউর রহমান, বায়োটেকনোলজি অ্যান্ড জেনেটিক ইঞ্জিনিয়ারিং (বিজিই) বিভাগের অধ্যাপক ড. এ কে এম মহিউদ্দিন এবং এনভায়রনমেন্টাল সায়েন্স অ্যান্ড রিসোর্স ম্যানেজমেন্ট (ইএসআরএম) বিভাগের অধ্যাপক ড. এ এস এম সাইফুল্লাহ।
জানা গেছে, ড. মো. মতিউর রহমান জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয় থেকে স্নাতক ও স্নাতকোত্তর ডিগ্রি সম্পন্ন করে ২০০৩ সালে বিশ্ববিদ্যালয়ের সিএসই বিভাগের প্রভাষক হিসেবে নিয়োগ পান। এর আগে তিনি বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশনে শিক্ষকতা করেন।
২০১৪ সালে জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয় থেকে পিএইচডি ডিগ্রি অর্জন করেন মতিউর রহমান। এ ছাড়া ইরাসমাস মুন্ডাস ইউরোপ-এশিয়া (ইএমইএ) পিএইচডি এক্সচেঞ্জ স্টুডেন্টস স্কলারশিপ পোগ্রামে পোল্যান্ডের ইউনিভার্সিটি অব ওয়ারশে কাজ করেন। দেশি-বিদেশি জার্নালে তার ৯০টির বেশি গবেষণাপত্র প্রকাশিত হয়েছে।
অধ্যাপক মতিউর রহমান প্রায় ২৬ বছরের শিক্ষকতা জীবনে বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রথম প্রক্টর, শিক্ষক সমিতির প্রতিষ্ঠাকালীন সাধারণ সম্পাদক, রিজেন্ট বোর্ড সদস্য, হল প্রভোস্ট, ইঞ্জিনিয়ারিং অনুষদের ডিন, সিএসই বিভাগের দুইবারের সভাপতি, একাডেমিক কাউন্সিলের সদস্য, গুচ্ছ ভর্তি পরীক্ষায় কারিগরি কমিটির (মাভাবিপ্রবি) প্রধানসহ গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্ব পালন করেছেন।
সূত্র বলছে, বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের সময় শিক্ষার্থী হত্যার প্রতিবাদে মুখে কালো কাপড় বেঁধে প্রতিবাদ ও শিক্ষার্থীদের দাবির সাথে একমত পোষণ করে বিবৃতি প্রদান করায় শিক্ষার্থীদের কাছে গ্রহণযোগ্যতার দিক থেকে সবথেকে এগিয়ে রয়েছেন তিনি।
উচ্চশিক্ষালয়টির ভিসি পদে আলোচনায় থাকা আরেক শিক্ষক ড. এ কে এম মহিউদ্দিন জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয় (তৎকালীন জগন্নাথ কলেজ) থেকে উদ্ভিদবিদ্যা বিভাগ থেকে স্নাতক ও স্নাতকোত্তর সম্পন্ন করেন। ২০০৬ সালে সহকারী অধ্যাপক পদে তিনি মাভাবিপ্রবিতে যোগদান করেন।
মালয়েশিয়ার ‘ইউনিভার্সিটি পুত্র মালয়েশিয়া’ (ইউপিএম) থেকে পিএইচডি ডিগ্রি অর্জন করেন এ কে এম মহিউদ্দিন। এ ছাড়া তিনি দীর্ঘ শিক্ষকতা জীবনে বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক সমিতির সভাপতি, বিভাগীয় চেয়ারম্যান, লাইফ সায়েন্স অনুষদের ডিন, রিসার্চ সেলের পরিচালক, পরিবহন পরিচালক এবং আইকিউএসির সহকারি পরিচালকসহ বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ পদে দায়িত্ব পালন করেছেন।
এ ছাড়া টাঙ্গাইলের এই বিশ্ববিদ্যালয়টির শীর্ষ পদের দৌড়ে থাকা আরেক শিক্ষক ড. এ এস এম সাইফুল্লাহ চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের সামুদ্রিক বিজ্ঞান বিষয়ে স্নাতক এবং পরিবেশ দূষণ ও ব্যবস্থাপনা বিষয়ে স্নাতকোত্তর সম্পন্ন করেন। ২০০৪ সালে তিনি মাভাবিপ্রবির প্রভাষক পদে যোগদান করেন।
জার্মানির টেকনিক্যাল ইউনিভার্সিটি অফ ডর্টমুন্ড থেকে উচ্চশিক্ষা এবং মালয়েশিয়ার ইউনিভার্সিটি পুত্র মালয়েশিয়া (ইউপিএম) থেকে পিএইচডি ডিগ্রি অর্জন করেন। তিনি বর্তমানে বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক সমিতির সভাপতি এবং ইএসআরএম বিভাগের চেয়ারম্যান হিসেবে দায়িত্ব পালন করছেন। এ ছাড়া তিনি লাইফ সায়েন্স অনুষদের ডিন, শিক্ষার্থী কল্যাণ ও পরামর্শ দান কেন্দ্রের পরিচালকসহ গুরুত্বপূর্ণ বিভিন্ন পদে দায়িত্ব পালন করেছেন।
প্রসঙ্গত, দেশের প্রায় সব বিশ্ববিদ্যালয়ে সরকারের সর্বোচ্চ পর্যায় থেকেই ভিসি নিয়োগ হয়ে থাকে। যেহেতু তীব্র আন্দোলনে শেখ হাসিনা সরকারের পতন হয়ে নতুন সরকার গঠন হয়েছে তাই শিক্ষার্থীবান্ধব, নিরপেক্ষ এবং একাডেমিক যোগ্যতাসম্পন্ন ব্যক্তিদের মধ্যে থেকেই এই পদটিতে নিয়োগ দেওয়া হবে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়সহ বেশ কয়েকটি বিশ্ববিদ্যালয়ের ভিসি পদে নিয়োগপ্রাপ্তদের সম্পর্কে বিস্তারিত সামনে আসার পর এমনটি মনে করা হচ্ছে।
তবে অনেকে মনে করছেন মাওলানা ভাসানী বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের শীর্ষ পদটিতে অভ্যন্তরীণ শিক্ষকদের মধ্য থেকে কাউকে নিয়োগ দেওয়া হবে না। ফলে এই উচ্চশিক্ষালয়ের উপাচার্য হিসেবে কে আসছেন সেটি নিশ্চিত হতে অপেক্ষা করতে সরকারের আনুষ্ঠানিক ঘোষণার দিকে।