বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর গুলি, সংঘর্ষ ও বিভিন্ন ধরনের সহিংসতায় এ মাসে মারা গেছেন ৫৫৬ জনেরও বেশি। নিহত ব্যক্তিদের মধ্যে শিক্ষার্থী, নারী, শিশু, বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের নেতাকর্মীসহ নানা শ্রেণিপেশার মানুষ রয়েছেন।
জুলাইতে নিহতের সংখ্যা ছিল আনুমানিক ২৫৩ জন। ১ জুলাই থেকে ৩১ আগস্ট পর্যন্ত সারা দেশে কমপক্ষে ৮০৯ জন নিহত হয়েছেন।
শনিবার (৩১ আগস্ট) মানবাধিকার সংস্কৃতি ফাউন্ডেশন (এমএসএফ) এর আগস্টের মানবাধিকার পরিস্থিতি মনিটরিং প্রতিবেদনে এ তথ্য উঠে এসেছে।
জাতিসংঘের মানবাধিকারবিষয়ক হাইকমিশনারের এক প্রতিবেদনের তথ্য অনুযায়ী, ১৬ জুলাই থেকে ১১ আগস্ট পর্যন্ত বিক্ষোভ ও পরবর্তী সহিংসতায় কমপক্ষে ৬৫০ জন বাংলাদেশি প্রাণ হারিয়েছেন। এ পর্যন্ত আহত হয়েছেন ৩৩ হাজারেরও অধিক।
প্রতিবেদনে বলা হয়, সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা, আওয়ামী লীগ সরকারের মন্ত্রী ও নেতাকর্মীদের নামে ২৬৮টি মামলা হয়েছে । যার মধ্যে সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নামে হয়েছে ১০০টি মামলা। এর মধ্যে দুটি গণহত্যা, একটি গুমের, একটি অপহরণ এবং দুটি হত্যাচেষ্টা মামলা এবং বাকিগুলো হত্যা মামলা।
এ ছাড়া আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালে তার বিরুদ্ধে ৭টি মামলা করা হয়েছে। দায়েরকৃত মোট মামলায় আসামির তালিকায় সুনির্দিষ্টভাবে নাম আছে প্রায় ২৬ হাজার ২৬৪ জনের। সেইসঙ্গে ‘অজ্ঞাতনামা’ আসামির সংখ্যা কমপক্ষে ১ লাখ ৬৮ হাজার ৫৫৫ জন।
প্রতিবেদনে আরও বলা হয়, রাজনৈতিক সহিংসতার ২৩টি ঘটনায় সহিংসতার শিকার হয়েছেন ২০৪ জন। তাদের মধ্যে ৯ জন নিহত ও ১৯৫ জন আহত হয়েছেন।
সহিংসতার ২৩টি ঘটনার মধ্যে ১২টি ঘটনা ঘটেছে বিএনপির অন্তদ্বন্দের কারণে, ৯টি বিএনপি-আওয়ামি লীগে, ১টি আওয়ামি লীগের অন্তদ্বন্দ্ব ও অপর ১টি ঘটনা ঘটেছে জামাতের সাথে বিএনপির। নিহতদের মধ্যে ৫ জন বিএনপির আর ৩ জন আওয়ামী লীগের কর্মী সমর্থক।
প্রতিবেদনে জানা যায়, কারা হেফাজতে গণমাধ্যম সূত্রে ৭ জনের মৃত্যুর সংবাদ প্রকাশিত হয়েছে। গত মাসে এর সংখ্যা ছিল দুজন। এ মাসে ১ জন হাজতি ও ৩ জন কয়েদির মৃত্যু হয়েছে। কেরানীগঞ্জের ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারে ২ জন, কাশিমপুর কেন্দ্রীয় কারাগারে ২ জন, ঝিনাইদহ জেলা কারাগারে ১ জন, রংপুর কেন্দ্রীয় কারাগারে বন্দিদের মধ্যে সংঘর্ষে ১ জনের মৃত্যু হয়েছে। সিরাজগঞ্জ জেলা কারাগারে শৌচাগারে ১ জন বন্দির ঝুলন্ত লাশ উদ্ধার করা হয়।
এ সময়ে দেশের বিভিন্ন জেলায় পেশাগত দায়িত্ব পালনের সময় ১৪ টি ঘটনায় ৩৭ সাংবাদিক নানাভাবে নির্যাতনের শিকার হয়েছেন। তাদের মধ্যে ৩৫ সাংবাদিক তাদের পেশাগত দায়িত্ব পালনের সময় আহত ও আক্রমণের শিকার হয়েছেন আর লাঞ্ছিত ও হুমকির শিকার হয়েছেন ২ সাংবাদিক।
নির্যাতনের শিকার সাংবাদিকের মধ্যে ২ জন নারী সাংবাদিক রয়েছেন। তারা হলেন চ্যানেল ২৪-এর সাতক্ষীরা জেলা প্রতিনিধি আমিনা বিলকিস ময়না এবং দৈনিক আমাদের সময় পত্রিকার ফটোসাংবাদিক এস এম তামান্না।
এদিকে রাজধানীর হাতিরঝিল লেক থেকে রাহানুমা সারাহ (৩২) নামে এক নারী সাংবাদিকের লাশ উদ্ধার হয়েছে। সাংবাদিকদের বিরুদ্ধে ৮টি মামলা করা হয়েছে। মামলায় অভিযুক্ত হয়েছেন ২৫ জন সাংবাদিক। ৮টি মামলার মধ্যে ৩টি হত্যা মামলা করা হয়েছে ঢাকায়, ১টি হত্যা মামলা বগুড়াতে, ১টি সিলেটে বিষ্ফোরক আইনে, ২টি মামলা রংপুরে যার একটি হত্যা মামলা আর অপরটি পীরগঞ্জে বিএনপি অফিসে ভাঙচুর ও ১টি মামলা হয়েছে রাজশাহীতে চাঁদাবাজি ও সাইবার নিরাপত্তা আইনে।
অভিযুক্তদের মধ্যে দুই, সাংবাদিক শাকিল আহমেদ ও ফারজানা রুপা গ্রেপ্তার হয়েছেন। এ ছাড়াও ২৯ আগস্ট আইনজীবী এমএইচ গাজী তামিম জুলাইয়ে শিক্ষার্থীদের আন্দোলনের সময় গণহত্যার অভিযোগে শেখ হাসিনা ও ৩২ সিনিয়র সাংবাদিকসহ ৫২ জনের বিরুদ্ধে তদন্ত সংস্থায় অভিযোগ দাখিল করেছেন।
সাইবার নিরাপত্তা আইনে ২টি মামলার ১টিতে গ্রেফতার হয়েছেন ১ জন, অপর মামলায় অভিযুক্ত করা হয়েছে ৪ জন সাংবাদিকসহ আরও অজ্ঞাত ৫ জনকে আসামি করা হয়েছে।
সীমান্তে বিএসএফ কর্তৃক গুলিতে ৩ বাংলাদেশী নাগরিক নিহত, গুলিবিদ্ধ হয়ে আহত হয়েছেন ৩ বাংলাদেশী নাগরিক। অপরদিকে ভারতীয় সীমান্তরক্ষী বাহিনী (বিএসএফ) ৮ বাংলাদেশী নাগরিককে আটক করে ধরে নিয়ে গেছে।
প্রতিবেদনে জানা যায়, ৩৭টি জেলায় ধর্মীয় ও জাতিগত সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের ওপর হামলা হয়েছে। তাদের বাড়ি-ঘর, মন্দির,মঠ, লুটপাট, ভাঙচুর ও অগ্নি সংযোগের ১৪৮ টি ঘটনা ঘটেছে। এর মধ্যে ধর্মীয় সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের ওপর হামলার ঘটনা ১৪১ ও ৭ টি সহিংসতার ঘটনা ঘটেছে জাতিগত সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের উপর।
১৩৮টি নারী ও শিশু নির্যাতনের ঘটনা সংঘটিত হয়েছে যা গত মাসের তুলনায় ১২৭টি কম। এ মাসে ধর্ষণের ঘটনা ১৯টি, সংঘবদ্ধ ধর্ষণ ৮টি, ধর্ষণ ও হত্যা ২টি। এর মধ্যে ধর্ষণের শিকার হয়েছে ৩ জন প্রতিবন্ধী শিশু ও কিশোরী।