কয়েক বছরে এক-দুইবার ভারি বৃষ্টিপাত হলে, তার সঙ্গে উজান থেকে নেমে আসা পাহাড়ি ঢলের পানি মিলে তৈরি হয় বন্যা। এতে ব্রাহ্মণবাড়িয়ার আখাউড়ার সীমান্তবর্তী নিম্নাঞ্চল প্লাবিত হয়। সম্প্রতি আকস্মিক ব্যাপক বন্যায় উপজেলার ৪০ গ্রাম প্লাবিত হয়। মূলত ঢলের পানি আটকে থাকার কারণ হিসেবে কয়েকটি খাল ও নদী দখল-দূষণের কথা বলছেন স্থানীয়রা। প্রভাবশালীদের দখলে বহু আগেই জৌলুস হারিয়েছে যেসব নদী, খাল তার মধ্যে অন্যতম কালন্দি খাল। এ খালের অনেক অংশই দখল করে গড়ে তোলা হয়েছে স্থাপনা। এতে সরু হয়ে খাল স্বাভাবিক গতি হারিয়েছে ।
ভারতের ত্রিপুরা রাজ্যের রাজধানী আগরতলা থেকে সীমান্ত পার হয়ে উপজেলার স্থলবন্দর, গাজীর বাজার, নারায়ণপুর বাইপাস মোড়, পৌর এলাকার সড়ক বাজার ও বড় বাজার দিয়ে প্রবাহিত হয়ে তিতাস নদীতে মিলিত হয়েছে কালন্দি খাল। ত্রিপুরা রাজ্যের আগরতলার পানিও এই খাল দিয়ে প্রবাহিত হয়। এক সময়ের খরস্রোতা কালন্দি খাল দখল আর দূষণে এখন মৃতপ্রায়।
আখাউড়া প্রকৃতি ও পরিবেশ ক্লাব নামে একটি সংগঠনের দীর্ঘদিনের আন্দোলনের প্রেক্ষিতে ২০২২ সালের নভেম্বরে কালন্দি খালটি দখল ও দূষণমুক্ত করার উদ্যোগ নেয় উপজেলা প্রশাসন। প্রায় পাঁচ কিলোমিটার দৈর্ঘ্যের খালটিতে ৩৪ প্রভাবশালী ব্যক্তির শতাধিক অবৈধ স্থাপনা চিহ্নিত করে নামমাত্র অভিযান পরিচালনা করে উচ্ছেদ অভিযান শেষ করা হয়।
আখাউড়া উপজেলা ভূমি কার্যালয় সূত্রে জানা গেছে, পৌর এলাকার প্রাণকেন্দ্রের ৩৭৫ ও ১৪৯ দাগের অংশে সবচেয়ে বেশি দূষণ ও দখল হয়েছে। শহরের ভেতরে হওয়ায় দখলদারদের নজর খালের ওপর। স্বাধীনতার পাঁচ দশক পর খালটি দখলমুক্ত করার উদ্যোগ নেওয়ায় খুশি হয়েছিলেন স্থানীয় বাসিন্দাসহ প্রকৃতিপ্রেমীরা। কিন্তু ওই উচ্ছেদ অভিযানের পর প্রায় দুই বছর পেরিয়ে গেছে। তবুও কালন্দি খালে প্রাণ ফেরানোর কোনো উদ্যোগ না নেওয়ায় এখন হতাশ স্থানীয় বাসিন্দা ও পরিবেশ কর্মীরা।
স্থানীয় পরিবেশ কর্মীরা বলেন, দখল-দূষণের কারণে কোনো খালেরই পানিপ্রবাহ ঠিক নেই। প্রভাবশালীদের দখলে বিলীন হয়েছে খাল ও নদীর অনেকাংশ। তাই পানি সরে যাওয়ার পথ রুদ্ধ হওয়ায় বন্যার দুর্ভোগ প্রকট হয়ে উঠেছে। এতে সীমাহীন দুর্ভোগের মুখে পড়ছেন সীমান্তবর্তী এলাকার বাসিন্দারা।
স্থানীয় বাসিন্দা সৈকত আলী বলেন, ছোটবেলায় দেখেছি এই খাল দিয়ে নৌকা চলেছে। অনেক পানিপ্রবাহ ছিল। কিন্তু আস্তে আস্তে এটি দখলের কারণে মরা খালে পরিণত হয়েছে। দীর্ঘদিন খালটি খনন না হওয়ায় জলাবদ্ধতা সৃষ্টি হয়।
পৌরশহরের রাধানগরের বাসিন্দা দীপক ঘোষ বলেন, পৌরশহরের বৃহত্তর এলাকা রাধানগর ও সড়ক বাজারের মধ্য দিয়ে কালন্দি খালটি প্রবাহিত। এটি যুগে যুগে ভরাট হয়ে যাওয়ায় এখন আর পানি প্রবাহিত হয় না। একটুতেই জলাবদ্ধতা সৃষ্টি হয়। ময়লা-আবর্জনার স্তূপ জমে জনগণের দুর্ভোগ বেড়েছে। খালটি উদ্ধারের জন্য একটি সংগঠন, সাংবাদিক ও সুশীল সমাজ একটি সামাজিক আন্দোলন গড়ে তুলেছিল, যা এখন সময়ের দাবি।
আখাউড়া প্রকৃতি ও পরিবেশ ক্লাবের উপদেষ্টা বিশিষ্ট আইনজীবী অ্যাডভোকেট আকছির এম চৌধুরী বলেন, উজানের পানি ভাটি অঞ্চলে প্রবাহিত হবে এটা স্বাভাবিক। কিন্তু আমাদের দুর্ভাগ্য যে, আখাউড়া নদী-খাল দখল ও দূষণে এখন মরা খাল-নদীতে পরিণত হয়েছে। বিশেষ করে কালন্দি খাল, জাজি গাং, হাওড়া নদী। তাছাড়া অপরিকল্পিত ব্রিজ কালভার্ট নির্মাণেও পানি প্রবাহ বাধাগ্রস্ত হয়েছে। তিতাস নদী একসময় খরস্রোতা নদী ছিল।
এ নদীতে বড় বড় নৌযান চলাচল করত। কালের পরিক্রমায় আজ তিতাস নদী না চাষাবাদের জমি বুঝা কঠিন। এসব নদী-খাল পরিচর্যা করে সংস্কার করতে হবে। দখল ও দূষণমুক্ত করে পানিপ্রবাহ ঠিক করতে হবে। তা না হলে সামনে আরও ভয়াবহ বন্যার মুখোমুখি হবে আখাউড়ার মানুষজন।
আখাউড়া উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) গাজালা পারভীন রুহি বলেন, আমরা এগুলো নিয়ে বসবে। কোথায় খাল রয়েছে, সেগুলো কতটুকু ভরাট হয়েছে, সে বিষয়ে জরিপ না করে এখনই কিছু বলা যাচ্ছে না। তবে আমরা অবশ্যই চাইবো প্রাকৃতিক পানিপ্রবাহ যেভাবে হয় সেভাবে যেন ব্যবস্থা করা যায়।