চিকিৎসক ও নার্সের অবহেলা ও অদক্ষতায় নবজাতকের মৃত্যুর অভিযোগ উঠেছে রাজধানীর বেসরকারি বি আর বি হসপিটাল লিমিটেডের বিরুদ্ধে। গত ২৯ আগস্ট রাজধানীর মোহাম্মদপুরের বাসিন্দা মাকসুদুল হাসান ও আয়েশা দম্পতির তৃতীয় সন্তান চিকিৎসাধীন অবস্থায় মারা যায়। স্বজনদের দাবি নার্সের ভুলে অতিরিক্ত রক্তক্ষরণে তার মৃত্যু হয়। মৃত্যুর আগে তার বয়স হয়েছিল ১ মাস ৩ দিন।
মাকসুদুল হাসান কালবেলাকে জানান, গত ২৬ জুলায় মাত্র ৭ মাসেই বি আর বি হাসপাতালে ডা. নাজমুন্নাহারের অধীনে জন্ম নেয় আমার সন্তান। শুরু থেকেই হাসপাতালের চিকিৎসক ও নার্সদের খামখেয়ালি ও অদক্ষতার স্বীকার হয় আমার স্ত্রী ও সন্তান। অপরিণত হওয়ায় জন্মের পর থেকেই হাসপাতালটির নিবিড় পর্যবেক্ষণ ইউনিটে চিকিৎসাধীন রাখা হয়। তবে গত ২৩ আগস্ট নার্স মিনতির খামখেয়ালিপনাবশত শিশুর মাথায় লাগানো ক্যানলা খুলে যায় এবং রক্তক্ষরণ হতে থাকে। বাচ্চার মা বিষয়টি শুরুতে লক্ষ্য করে দ্রুত নার্সদের সহযোগীতা চাইলেও তাদের সারা পাওয়ানি।
নবজাতকের মা আয়শা অভিযোগ করে বলেন, আমি নার্সকে বললে তিনি দ্রুত কোনো সমাধান দিতে পারেনি। পরে আমি নিজেই দৌড়ে উপরের তলায় ছুটে যাই এবং সিনিয়ির নার্সদের জানাই। ওই সময়ও তারা কে যাবে না যাবে তা নিয়ে গড়িমসি করতে থাকে।
তিনি আরও বলেন, একপর্যায়ে আমার সাথে একজন আসলেও সাথে রক্তক্ষরণ বন্ধ করার জন্য কিছুই সাথে নেননি। নিচে এসে খালি হাতে রক্তক্ষরণের স্থান চেপে ধরে। এই সময়ের মধ্যে আমার বাচ্চার শরীরে জড়ানো তিনিটি তাওয়েল বেয়ে গড়িয়ে রক্ত পড়তে থাকে।
জানা যায়, ঘটনার আগে কোনো ধরণের সতর্কতা বা স্বাস্থ্যবিধি না মেনেই বাবা-মার মাধ্যমে এআইসিউতে থাকা সংবেদনশীল শিশুটিকে কনট্রাস্ট এক্সের জন্য হাসপাতালের দ্বিতীয় তলায় পাঠানো হয়। এ সময় এক্সের টেকনোলজিস্ট খোরশেদ আলম টেস্ট সমাপ্ত হওয়ার আগেই আরেকজনের টেস্ট করানো হবে বলে শিশুটিকে সরাতে বলেন।
আয়শা বলেন, এনআইসিইউতে চিকিৎসাধীন একটা সেনসেটিভ বাচ্চার ক্ষেত্রে তারা কোনো প্রটকল মানেনি। আমাদের বলা হয়েছিল টেস্টের সময় আমাদের শুধু উপস্থিত থাকতে হবে, আর কিছুই না। সংবেদনশীল অবস্থা হওয়ায় নার্সরাই যা করার করবেন। অথচ পরে আমাদের বলা হলো বাচ্চার দুই হাত-পা ধরার জন্য। হাত পরিষ্কারের জন্য হ্যাক্সাসল পর্যন্ত আমাদের চেয়ে নিতে হয়েছে।
তিনি আরও বলেন, ৩ ঘণ্টার টেস্ট এক ঘণ্টা পার হতে না হতেই টেকনোলজিস্ট খোরশেদ আলম আমাদের বাচ্চাকে সরাতে বলেন। এ সময় আমরা প্রতিবাদ করে বলি, একটি রানিং (চলমান) টেস্টের সময় আরেকজনের টেস্ট করাবেন, এটা কেমন কথা। এই কথা বলে আমরা বাচ্চাকে নার্সের হাতে দেই। এর কিছুক্ষণ পরই আমি খেয়াল করি, আমার বাচ্চার শরীরে থাকা তিনটি তাওয়াল ভিজে নিচে গড়িয়ে করে রক্ত পড়ছে। রক্ত বন্ধ করতে তুলা কে আনবে তা নিয়ে পর্যন্ত গড়িমসি করতে থাকে। তখন আমি নিজেই দৌড়ে আবার ওপরে গিয়ে তুলা নিয়ে আসি। অথচ তাওয়ালে লাগা রক্ত দ্রুত পরিষ্কার করে নেয় নার্সরা।
জানা যায়, সেদিন দুপুর ১২টায় কেএমসি (ক্যাঙ্গারু মাদার কেয়ার) দিয়ে বাসায় ফেরেন আয়শা। সে সময়ও বেশ স্বাভাবিক ছিল তার বাচ্চা। কিন্তু এই দুই ঘণ্টা পরই তাদের আবারও ফোন করে হাসপাতালে আনা হয়। শনিবার পরীক্ষা করানোর কথা থাকলেও অনেকটা তাড়াহুড়ো করেই শুক্রবার তাকে পরীক্ষার জন্য পাঠানো হয়। এর কারণও স্বজনদের ব্যাখ্যা করেনি এনআইসিইউর দায়িত্বরত চিকিৎসক মাইমুনা। তাছাড়া ঐ সময়ই বাচ্চার বাবা-মা আবিষ্কার করেন নবজাতকের হাতের ক্যানলা খুলে মাথায় লাগানো হয়েছে। একই সাথে দুই ঘণ্টা আগে স্বাভাবিক বাচ্চা নিস্তেজ হয়ে পড়েছে। এসব ঘটনার কোনো ব্যাখ্যা চেয়েও পাননি তারা। এরপর থেকেই বাচ্চার অবস্থা খারাপ হতে থাকে এবং অতিরিক্ত রক্তক্ষরণে শকে চলে যায়। এই খবরটিও শুরুতে তাদের কাছে গোপন করা হয় বলে দাবি করেন মাকসুদুল হাসান ও আয়েশা দম্পতি। রোগীর এমন অবস্থা রোগীর চিকিৎসককে অবগত করা নিয়েও মিথ্যাচার করেছে দায়িত্বরত চিকিৎসক ডা. মাইমুনা, এমন গুরুতর অভিযোগ করেন তারা। ঘটনার পর দিন কর্তব্যরত চিকিৎসক ডা. নাজমুন্নাহারের সাথে সাক্ষাৎ করা হলে তাকে এ বিষয়ে জানানো হয়নি বলে দাবি করেন তিনি। তার বিরুদ্ধে রোগীর স্বজনদের সাথে দুর্ব্যবহারেরও অভিযোগ রয়েছে।
এদিকে হাসপাতাল থেকে বলা হয় রোগীর শরীর থেকে ১০ মিলিমিটার রক্তক্ষরণ হয়েছে। কিন্তু তার বিপরীতে রোগীর শরীরে ৩ ব্যাগ রক্ত দেওয়া হয়েছে বলে জানা যায়। ঘটনার ৬ দিন পর ২৯ আগস্ট ভোরে মারা যায় শিশুটি। এসব অভিযোগ ডিরেক্টর অব মেডিকেল সার্ভিস (ডিএমএস) ডা. জামিল আহমেদকে জানানো হলে তিনি যথাযথ ব্যবস্থা নেওয়ার আশ্বাস দেন বলে জানান মাকসুদুল হাসান। তবে হাসপাতাল থেকে গত ২৩ আগস্ট থেকে ২৯ আগস্ট পর্যন্ত রোগীকে প্রদান করা ট্রিটমেন্ট হিস্টোরি চাইলে তা দিকে অস্বীকৃতি জানায় হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ। এমনকি মৃত্যু সনদেও মৃত্যূর আসল কারণ লেখা হয়নি বলেও গুরুতর অভিযোগ করেন স্বজনরা।
এসব অভিযোগের ব্যাপারে বুধবার (৪ সেপ্টেম্বর) কর্তৃপক্ষের সাথে কথা বলতে বি আর বি হাসপাতালে যায় কালবেলা। সেখানে গিয়ে দেখা যায় , এখনো বহাল তবিয়তে আছেন অভিযুক্ত ডা. নাজমুন্নাহার, নার্স মিনতি, ডা. মাইমুনা ও টেকনোলজিস্ট খোরশেদ আলম। এসব বিষয়ে ডিএমএসের সাথে কথা বলতে চাইলে তিনি কথা বলবেন না বলে জানায় হাসপাতালের হেড অব ব্যান্ড কমিউনিকেশন মো. রফিকুল ইসলাম। হাসপাতালে নবজাতকের অবহেলাজনিত মৃত্যর ঘটনায় গেল ৬ দিনে কী পদক্ষেপ গ্রহণ করা হয়েছে জানতে চাইলে পরিষ্কার কিছুই জানাতে পারেননি তিনি। কোনো তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়েছে কিনা তা নিয়েও নিশ্চিত করে কিছু বলতে পারেননি রফিকুল ইসলাম। তবে কয়েকদিনের মধ্যে এ বিষয়ে মিডিয়ায় তারা কথা বলবেন বলে জানান তিন।