আমার ছেলের ইচ্ছে ছিল বড় হয়ে সেনাবাহিনীতে চাকরি করবে। দেশের মানুষের জন্য কাজ করবে। আমার এখন আশা-ভরসা কোনো কিছু নেই। আমার বুকটার মধ্যে হাহাকার, আমার ছেলে নেই, এ কথা আমি কখনো ভাবতেই পারছি না। আমার কলিজাটা ছিঁড়ে যাচ্ছে। আমার অনেক সাধনার ছেলে ছিল। মারুফকে যারা হত্যা করেছে তাদের উপযুক্ত বিচার চাই।
ছেলেকে হারিয়ে কান্নাজড়িত কণ্ঠে এ কথাগুলো বলছিলেন বৈষম্যবিরোধী আন্দোলনে নিহত শহীদ মারুফ মিয়ার (১৫) মা মোর্শেদা। একমাত্র ছেলেকে হারিয়ে মারুফের মা এখন পাগল প্রায়।
জানা যায়, টাঙ্গাইল পৌরশহরের সাবালিয়া স্টেশন রোড এলাকার মনজু মিয়া ও মোর্শেদার একমাত্র ছেলে মারুফ মিয়া (১৫)। গত ৫ আগস্ট সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার পদত্যাগের পর বৈষম্যবিরোধী ছাত্র-জনতার আনন্দ মিছিলে সংঘর্ষের ঘটনা ঘটে। এ সময় পৌরশহরের আমঘাট মোড় এলাকায় শিক্ষার্থী মারুফ মিয়া গুলিবিদ্ধ হয়ে মারা যায়।
তাদের বাড়িতে গিয়ে দেখা গেছে, বাড়িতে বসে ছেলের জন্য বিলাপ করছে মারুফের মা। আর মারুফের কথা বলছে। তাদের রয়েছে ছোট একটি টিনশেড ঘর। এক কক্ষে তার মা ও বোন থাকত, আরেকটি কক্ষে মারুফ। বাড়িতে এখন তার মা ও বোন বসবাস করেন।
পরিবারের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, মারুফের বাবা মনজু মিয়া ওয়ালটন কোম্পানিতে চাকরি করতেন। সে টাকা দিয়ে দুই সন্তানের লেখাপড়ার খরচ ও সংসার চালাত। তারপর যে টাকা বাঁচত, তা জমা করে রাখত। সংসারে সচ্ছলতা ফিরিয়ে আনতে ওয়ালটনের চাকরি ছেড়ে গত জুন মাসে প্রবাসে পাড়ি জমান মনজু মিয়া। মাথায় ঋণের বোঝা থাকায় এই সংকটময় মুহূর্তে দেশেও আসতে পারছেন না শহীদ মারুফের বাবা। মারুফকে মানুষের মতো মানুষ করতে তার বাবা-মা শহরে আসেন।
১১ বছর আগে জেলার বাসাইল উপজেলার ফুলকি ইউনিয়নের জশিহাটি গ্রাম থেকে টাঙ্গাইল শহরের সাবালিয়া স্টেশন রোড এলাকায় জমি কিনে ঘর তোলেন। এরপর থেকে তারা এখানেই বসবাস করে আসছেন।
পৌরশহরে সাবালিয়া স্টেশন রোড এলাকায় মারুফের বাড়ি। তারা এক ভাই ও এক বোন। মারুফ বড় ছিল। ছোট বোন সানজিদা ষষ্ঠ শ্রেণির শিক্ষার্থী। মারুফ শহরের রেজিস্ট্রি পাড়া শাহীন স্কুলে নার্সারি থেকে পঞ্চম শ্রেণি পর্যন্ত পড়াশোনা করেছে। তারপর শহরের সৃষ্টি স্কুলে ষষ্ঠ থেকে অষ্টম শ্রেণি পর্যন্ত পড়াশোনা করে। এরপর নবম শ্রেণিতে আবার শাহীন স্কুলে ভর্তি হন। মারুফ ওই স্কুলের দশম শ্রেণির শিক্ষার্থী ছিল।
মারুফের সহপাঠী তামান্না ইসলাম তরি বলে, মারুফ অনেক মেধাবী ও ভালো ছেলে ছিল। মারুফকে যেভাবে হত্যা করা হয়েছে আমরা তা মেনে নিতে পারছি না। মারুফ মারা যাওয়াতে তার পরিবারের সবাই ভেঙে পড়েছে। সরকারের কাছে দাবি ওর বাবা-মা ও বোন যেন সুন্দরভাবে চলতে পারে সে জন্য পরিবারের কাউকে একটা চাকরির ব্যবস্থা করে দেওয়া হোক। মারুফকে যারা হত্যা করেছে সঠিক তদন্ত করে তাদের সর্বোচ্চ শাস্তি দেওয়া হোক।
বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের তাওহীদা ইসলাম স্বপ্নীল জানিয়েছেন, মারুফ আমার এলাকার ছেলে। খুবই সাহসী ছিল। একমাত্র সন্তানকে হারিয়ে খুবই কষ্টের মধ্যে আছে তার পরিবার। সরকারের প্রতি অনুরোধ মারুফের পরিবারের দিকে একটু নজর দেওয়ার জন্য। এছাড়াও রাষ্ট্রীয় যে প্রাপ্য সেটা মারুফের পরিবারকে দেওয়ার অনুরোধ জানাচ্ছি।
তিনি আরও বলেন, সাবালিয়া এলাকায় একটি খেলার মাঠ তৈরি করে যেন মারুফের নামে করা হয়। মারুফের বাড়িতে আসার যে রাস্তা বৃষ্টি হলে তা জলাবদ্ধতার সৃষ্টি হয়। সে রাস্তা যেন সংস্কার করে মারুফের নামে নামকরণ করা হয়। সরকারের কাছে জোর দাবি জানাচ্ছি মারুফ হত্যার বিচার খুব দ্রুত করতে হবে।
মারুফের মা মোর্শেদা বলেন, গত ৪ আগস্ট বিকাল ৩টায় মারুফ মিছিল থেকে বাড়িতে আসে। তখন মারুফকে বলছি বাবা আর তুমি মিছিলে যেও না। পরের দিন ৫ আগস্ট বিকার ৩টায় একসঙ্গে বসে খাওয়ার সময় শেখ হাসিনা পালিয়ে গেছে এ খবর আসামাত্রই বিজয় মিছিলের উদ্দেশ্যে তাড়াহুড়ো করে কাপড় পরে আমার ছেলে বের হয়ে যায়।
আমি পিছনে পিছনে গেট পর্যন্ত যাই। প্রথমে মারুফকে না করেছি, মিছিলে না যেতে। তখন ওর বন্ধুরা ও মারুফ বলে, আজকে কিছু হবে না। কোনো ভয় নেই, আজ বিজয় মিছিল। পরে বিজয় মিছিলে যেতে দেই। তখন আমি মারুফকে বলি বাবা তাড়াতাড়ি চলে এসো। পরে মারুফ যাওয়ার সময় শুধু বলে, বিজয় মিছিল শেষ করেই আমি চলে আসব মা।
বিজয় মিছিল শেষে মারুফ ফিরে এলো ঠিকই, কিন্তু লাশ হয়ে। মারুফ ছিল আমাদের ভবিষ্যৎ। বড় হয়ে চাকরি করবে, পরিবারের হাল ধরবে- সে আশা ছিল। ছেলে-মেয়ের জন্য ওর বাবা বিদেশ গেছে তিন মাস হলো। ছেলে পড়াশোনা করবে, চাকরি করবে, ওর বাবার পাশে দাঁড়াবে। সে আশাই ছিল আমাদের। কিন্তু এখন সব আশা ও স্বপ্ন ভেঙে তছনছ হয়ে গেছে। কাকে নিয়ে আমি বাঁচব। কাকে নিয়ে আমি স্বপ্ন দেখব।
মারুফের মা আরও বলেন, সরকার যদি আমাদের পাশে দাঁড়ায়, আমরা মেয়েকে নিয়ে ভালোভাবে বাঁচতে পারব। আমার ছেলেকে যারা হত্যা করেছে সুষ্ঠু তদন্ত করে তাদের বিচারের আওতায় আনা হোক। আমার ছেলে দেশের জন্য জীবন দিয়েছে। মারুফকে যেন রাষ্ট্রীয়ভাবে শহীদের মর্যাদা দেওয়া হয়। সব মানুষের মুখে যেন আমার মারুফের নাম থাকে। মারুফের স্মৃতি ধরতে রাখতে আমাদের বাড়ির দিকে যে রাস্তা এসেছে সে রাস্তা যেন শহীদ মারুফ রোড নামকরণ করা হয় এটা সরকারের কাছে দাবি জানাচ্ছি।
এদিকে গত ১৪ আগস্ট জেলা প্রশাসক কায়ছারুল ইসলাম শহরের সাবালিয়ায় মারুফের বাসায় গিয়ে তার পরিবারকে সার্বিকভাবে সহযোগিতার আশ্বাস দিয়েছেন। মারুফের মা মোর্শেদা বাদী হয়ে টাঙ্গাইল সদর থানায় সাবেক কৃষিমন্ত্রী ড. আব্দুর রাজ্জাক ও সাবেক বাণিজ্য প্রতিমন্ত্রী আহসানুল ইসলাম টিটুসহ ৫৬ জনের বিরুদ্ধে একটি হত্যা মামলা করেন। এছাড়াও ১৫০-২০০ জনকে অজ্ঞাতনামা আসামি করা হয়েছে।
উল্লেখ্য, গত ৫ আগস্ট সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার পদত্যাগের পর বৈষম্যবিরোধী ছাত্র-জনতার বিজয় মিছিলে অংশ নেয় মারুফ। এ সময় টাঙ্গাইল পৌরশহরের আমঘাট মোড় এলাকায় গুলিবিদ্ধ হয়ে মারা যায়। ৬ আগস্ট মঙ্গলবার দুপুরে শহরের কেন্দ্রীয় ঈদগাঁ মাঠে জানাজা শেষে তাকে গ্রামের বাড়ি বাসাইল উপজেলার ফুলকি ইউনিয়নের জশিহাটি গ্রামে দাফন করা হয়।