নদীর তীরে অবচেতন মনে এখনো চোখের পানি ফেলেন বরগুনা সদর উপজেলার ঢলুয়া এলাকার বাসিন্দা মো. আসলাম খাঁন। দীর্ঘ ১৭ বছর পরও ভুলতে পারেননি প্রলয়ঙ্করী ঘূর্ণিঝড় সিডরের তাণ্ডব। জলোচ্ছ্বাসের তীব্র স্রোতে হাত থেকে ছুটে পানিতে ডুবে মৃত্যু হয় স্ত্রী ও তিন বছর বয়সী কন্যা সন্তানের। শুধু আসলাম খান নন, যেকোনো ঘূর্ণিঝড়ের নাম শুনলে এখন আঁতকে উঠেন বরগুনার উপকূলবর্তী বিভিন্ন এলাকার স্বজন হারানো কয়েক হাজার বাসিন্দা।
এদিকে প্রলয়ঙ্করী ঘূর্ণিঝড় সিডরের ১৭ বছর পার হলেও এখনো ঝুঁকিপূর্ণই রয়েছে বরগুনার অধিকাংশ বেড়িবাঁধ। এসব এলাকার বাসিন্দাদের একটাই দাবি, প্রাকৃতিক দুর্যোগ থেকে জানমাল রক্ষায় নির্মাণ করা হোক স্থায়ী ও টেকসই বেড়িবাঁধ।
ঘূর্ণিঝড় সিডরের সেই ভয়াল স্মৃতির কথা স্মরণ করে আসলাম খাঁন বলেন, সিডরে আমার যে ক্ষতি হয়েছে তা পূরণ করা সম্ভব না। ওই সময় আমার স্ত্রী ও তিন বছরের মেয়েকে হারিয়েছি। এলাকায় সুন্দর পরিবেশে বসবাস করলেও বন্যা বা ঘূর্ণিঝড় হলেই পানিতে প্লাবিত হয়ে যায় বাড়িঘর। দুর্যোগ সামাল দেওয়ার মতো এখন পর্যন্ত কোনো টেকসই বেড়িবাঁধ নির্মাণ করা হয়নি। বর্তমানে যে বেড়িবাঁধ আছে তা স্বাভাবিক জোয়ারের তুলনায় তিন থেকে চার ফুট পানি হলেই ভেতরে পানি প্রবেশ করে ঘরবাড়ি তলিয়ে যায়। আমরা শুধু শুনি টেকসই বেড়িবাঁধ নির্মাণ হবে, কিন্তু তা এখনো হয়নি।
প্রলয়ঙ্করী ঘূর্ণিঝড় সিডর ২০০৭ সালের ১৫ নভেম্বর দেশের দক্ষিণ উপকূলে আঘাত হানে। এতে দেশের বিভিন্ন এলাকার প্রায় ৬ হাজার মানুষের প্রাণহানি, গবাদিপশুর মৃত্যু, ঘরবাড়ি বিধ্বস্ত ও ব্যাপক ফসলি জমির ক্ষয়ক্ষতি হয়। এ ছাড়া অসংখ্য এলাকার বেড়িবাঁধ ভেঙে বিলীন হয়ে যায়। এর মধ্যে সিডরের প্রলয়ঙ্করী তাণ্ডবে শুধু বরগুনায় নিহত হয়েছে এক হাজার ৩৪৫ জন মানুষ। তীব্র বাতাসসহ ১৫ থেকে ২০ ফুট উঁচু জলোচ্ছ্বাসে ঘরবাড়ি বিধ্বস্ত হয়ে গৃহহীন হয়ে পড়ে জেলার ৭৭ হাজার ৭৫৪টি পরিবার। কমবেশি আরও ক্ষতিগ্রস্ত হয় প্রায় ১৩ হাজার ৪৬১টি পরিবার। এ ছাড়া ৩০ হাজার ৪৯৯টি গবাদিপশু ও ৬ লাখ ৫৮ হাজার ২৫৯টি হাঁস-মুরগি মারা যায়। জলোচ্ছ্বাসে বিভিন্ন এলাকার প্রায় ৩৮ কিলোমিটার বেড়িবাঁধ ভেঙে বিলীন হয়ে যায়।
ঘূর্ণিঝড় সিডরের পর দীর্ঘ ১৭ বছরে বিভিন্ন সময়ে আইলা, মহাসেন, রেমালসহ আরও অনেক প্রাকৃতিক দুর্যোগের মুখোমুখি হতে হয়েছে বরগুনার উপকূলের বিভিন্ন এলাকার বাসিন্দাদের। নিচু ও নাজুক বেড়িবাঁধের ফলে প্রতিবারই বাঁধ ভেঙে কমবেশি ক্ষতিগ্রস্ত হতে হচ্ছে তাদের। বরগুনার বিভিন্ন সচেতন নাগরিকদের দাবি সরকারের বরাদ্দ বাড়িয়ে দুর্নীতি মুক্ত রেখে সঠিকভাবে টেকসই বেড়িবাঁধ নির্মাণ করা হলে উপকূলের মানুষ ঘূর্ণিঝড় ও জলোচ্ছ্বাসের কবল থেকে রক্ষা পাবে।
বরগুনার সচেতন নাগরিক কমিটির (সনাক) সভাপতি মনির হোসেন কামাল বলেন, আমাদের উপকূলীয় অঞ্চলে বিশেষ করে সিডরে বেশি ক্ষতি হয়েছে। ওই সময় ২০ থেকে ২৫ ফুট উঁচু জলোচ্ছ্বাসে আমাদের অনেক বেড়িবাঁধ ভেঙে গিয়েছিল। পরবর্তীতে ২০০৮ সালে আবার আইলা হয়েছে, এতেও বেড়িবাঁধের ক্ষতি হয়েছিল। এরপর থেকেই প্রায় ৫ কিলোমিটার বেড়িবাঁধ এখনো ঝুঁকিপূর্ণ রয়েছে। এ ছাড়া যেসব বেড়িবাঁধ নির্মাণ করা হয়েছে তাও নামেমাত্র। পাকিস্তান আমলে যে উচ্চতায় বেড়িবাঁধ নির্মাণ করা হয়েছিল সে তুলনায় বর্তমান বেড়িবাঁধের উচ্চতা অনেক কম। এ কারণে জলোচ্ছ্বাস হলেই এসব বেড়িবাঁধ উপচে পানি লোকালয়ের ভেতরে চলে আসে।
তিনি আরও বলেন, আমাদের দাবি হচ্ছে বেড়িবাঁধগুলো উঁচু ও টেকসইভাবে নির্মাণ করতে হবে। তবে আমরা বারবারই শুনি বেড়িবাঁধ নির্মাণে সরকারের তেমন কোনো বরাদ্দ নেই। নামমাত্র বরাদ্দ আসে যা দিয়ে টেকসই বেড়িবাঁধ নির্মাণ হয় না। এ ছাড়া লোপাট হয়ে যাচ্ছে ওই বরাদ্দেরও বড় একটি অংশ। ফলে যে বেড়িবাঁধ নির্মাণ হচ্ছে তা নামেমাত্র। এতে ঘূর্ণিঝড় বা জলোচ্ছ্বাস মোকাবিলা করা সম্ভব না।
সরেজমিনে বরগুনা সদর উপজেলার ঢলুয়া ইউনিয়নের বিষখালী নদী বেড়িবাঁধ এলাকা ঘুরে দেখা যায়, রশি দিয়ে বেঁধে রেখেছেন বেড়িবাঁধের আশপাশের অনেকেরই বসতঘর। প্রাকৃতিক বিভিন্ন দুর্যোগে জলোচ্ছ্বাস হলেই বাঁধ ভেঙে পানি প্রবেশ করে তলিয়ে যায় এখানকার বাসিন্দাদের ঘরবাড়ি। বারবার একই অবস্থার সৃষ্টি হলেও নেওয়া হয়নি টেকসই বেড়িবাঁধ নির্মাণের কোনো উদ্যোগ। স্থানীয়দের দাবি, দুর্যোগ পরবর্তী সময়ে প্রতিবারই নামমাত্র বেড়িবাঁধ মেরামত করা হয়। এতে ঝুঁকি নিয়ে বসবাস করতে হয় স্থানীয় বাসিন্দাদের।
ফিরোজা বেগম নামের ঢলুয়া এলাকার এক স্থানীয় বাসিন্দা ঢাকা পোস্টকে বলেন, প্রত্যেকবার বন্যা হলেই আমাদের বেড়িবাঁধ ভেঙে যায়। আমরা নদীর পাড়ের মানুষ ঘূর্ণিঝড় হলে ঘরে থাকতে পারি না। বাড়িঘর ছেড়ে আমাদের অনেক দূরে গিয়ে থাকতে হয়। আমাদের দাবি একটাই টেকসই বেড়িবাঁধ নির্মাণ করা হোক।
একই এলাকার বাসিন্দা পরীবানু বলেন, আমরা তো টেকসই বেড়িবাঁধ চাই, কিন্তু সরকার তো তা দেয় না। ঘূর্ণিঝড় হলে অনেক সময় থাকার জায়গা পাই না। আত্মীয়স্বজনের বাড়িতে গিয়ে আশ্রয় নিতে হয়।
বয়স কম থাকায় সিডরের প্রলয়ঙ্করী তাণ্ডবের চিত্র খুব বেশি মনে না থাকলেও বর্তমান সময়ে বেড়িবাঁধের কারণে এলাকার দুর্ভোগের বিষয়ে মো. শুভ বলেন, ছোটবেলায় যখন সিডর হইছে, তখন থেকেই আমাদের যে একটা বেড়িবাঁধের আকাঙ্ক্ষা তা এখনো পূরণ হয়নি। বন্যার আগে বেড়িবাঁধ ভালো থাকলেও পরে যখন ভেঙে গেছে তা আর টেকসইভাবে করা হয়নি। সরকার থেকে কোনো বরাদ্দ আসছে কি না তাও আমরা জানি না। তবে কয়েকবার শুনেছি বেড়িবাঁধের ভাঙন রোধে দুই থেকে তিনবার টেন্ডার হয়েছে। প্রতিবারই শুনি আগামী বছর টেকসইভাবে বাঁধ নির্মাণের কাজ হবে, কিন্তু আজ পর্যন্ত তা হয়নি। ছোটবেলায় দেখেছি স্বাভাবিক জোয়ার হলেও বেড়িবাঁধ তলিয়ে যায়। এতে এলাকার ছেলেমেয়েরা স্কুলে যাওয়া-আসা করতে পারত না। ১৭ বছর পর এখনো সেই একই অবস্থা রয়েছে। আমাদের ভোগান্তি কমাতে সরকারের কাছে বিনীতভাবে আবেদন করি যাতে অতিদ্রুত টেকসই বেড়িবাঁধ নির্মাণে পদক্ষেপ নেওয়া হয়।
পানি উন্নয়ন বোর্ডের তথ্য অনুযায়ী, বরগুনার বিভিন্ন এলাকায় প্রায় ৮০৫ কিলোমিটার বেড়িবাঁধ রয়েছে। সবশেষ ঘূর্ণিঝড় রেমালের প্রভাবে বিভিন্ন এলাকার প্রায় ১২ কিলোমিটার বেড়িবাঁধ ক্ষতিগ্রস্ত হয়। এর মধ্যে সম্পূর্ণ বিলীন হয়ে যায় ১১০০ মিটার। তবে বর্তমানে এসব বেড়িবাঁধের অল্প কিছু অংশ ঝুঁকিপূর্ণ থাকলেও অধিকাংশ ক্ষতিগ্রস্ত বেড়িবাঁধ মেরামত সম্পন্ন করা হয়েছে।
এ বিষয়ে পানি উন্নয়ন বোর্ডের নির্বাহী প্রকৌশলী রাকিব বলেন, বরগুনা যে ৮০৫ কিলোমিটার বেড়িবাঁধ রয়েছে এগুলো আমরা পর্যায়ক্রমে মেরামতের কাজ করি। চলমান বর্ষা মৌসুমে বিভিন্ন এলাকার প্রায় ১৫ কিলোমিটার বেড়িবাঁধ মেরামত করা হয়। এছাড়া বর্তমানে দুটি উন্নয়ন প্রকল্প চলমান রয়েছে। এর অধীনে প্রায় ৫০ কিলোমিটার বেড়িবাঁধের কাজ চলমান রয়েছে। তবে বেড়িবাঁধ মেরামত একটি চলমান প্রক্রিয়া, যখন যেখানে প্রয়োজন হয় তখন সেখানে কাজ করা হয়।
টেকসই বেড়িবাঁধ নির্মাণের স্থানীয় বাসিন্দাদের দাবির বিষয়ে জানতে চাইলে তিনি আরও বলেন, বর্তমানে দুটি উন্নয়ন প্রকল্পের আওতায় প্রায় সাড়ে ৮ কিলোমিটার বেড়িবাঁধের ঢাল সংরক্ষণ করতে সিসি ব্লক দিয়ে বাস্তবায়নের কাজ চলমান রয়েছে। এর আগে ইসিআরবি প্রকল্পের মাধ্যমে বরগুনার বিভিন্ন জায়গায় স্থায়ী বেড়িবাঁধ নির্মাণ করা হয়েছে। এ ছাড়া চলমান দুটি প্রকল্পসহ আরও দুটি প্রকল্পের প্রস্তাবনা দেওয়া আছে। এগুলো গৃহীত হলে ওই প্রকল্পের আওতায় স্থায়ী বেড়িবাঁধ নির্মাণ করা হবে বলে জানান তিনি।