‘ছেলেটা কালো বলে হয়ত কেউ চোখেই দেখে না’—বিপিএল মাতানো জাকের আলী অনিক নির্বাচকদের নজরে না আসায় এভাবেই আক্ষেপ করে বলছিলেন কোচ মোহাম্মদ সালাউদ্দিন। সেই জাকেরের জাতীয় দলে আবির্ভাব হয়েছিল অনেকটা নাটকীয়ভাবে। আরেকজনের ইনজুরিতে কপাল খুলে গিয়েছিল তার। অভিষেক ম্যাচেই নিজের ঘরের মাঠ সিলেটে ব্যাট হাতে ঝড় তুলে বুঝিয়ে দিয়েছিলেন কোচ সালাউদ্দিন বাড়াবাড়ি কিছু বলেননি।
সদ্য সমাপ্ত ক্যারিবীয় সফরে বাংলাদেশের পারফর্মার জাকের আলী। ভাগ্যের কি লিখন, ওয়েস্ট ইন্ডিজের বোলারদের কচুকাটা করে জাকের যখন ব্যাট হাতে দ্যুতি ছড়াচ্ছিলেন ডাগআউটে তখন বসে সেই সালাউদ্দিন। ক্যারিবীয়দের বিপক্ষে টেস্ট সিরিজ ড্র এবং টি-টোয়েন্টিতে হোয়াইটওয়াশ করার অন্যতম নায়কও টাইগার এই ব্যাটার।
জাকের আলী অনিকের পুরো পরিবারই খেলাধুলার সাথে জড়িত। নিজ জেলা হবিগঞ্জে একসময় জাকেরের পরিচয় ছিল ‘অপুর ভাই অনিক’। বড় ভাই শাকের আলী অপু বিভাগীয় পর্যায়ে ক্রিকেট খেলেছেন। পরিচিত ছিলেন হবিগঞ্জ নারী ক্রিকেট দলের অধিনায়ক ‘শাকিলা ববির ভাই’ হিসেবেও। ক্রিকেটের পথচলা শেষে এখন পুরোদস্তুর সাংবাদিকতা করছেন তিনি। টাইগার এই ব্যাটারের আরেকটি পরিচয় জাতীয় শুটার ‘নাফিসা তাবাসসুমের স্বামী’। আর তার বাবা ছিলেন আর্মিতে, খেলেছেন বাস্কেটবলসহ সব ধরনের খেলাই।
স্ত্রী শুটার, স্বামী ক্রিকেটার
দুই ক্রীড়াবিদ দুই ডিসিপ্লিনে দেশের জন্য খেলছেন। জাকেরের স্ত্রী নাফিসা তাবাসসুম বছর চারেক আগেই জাতীয় শুটার হয়েছেন। তাই নাফিসা স্বামীকেও জাতীয় দলের জার্সিতে দেখার অপেক্ষায় ছিলেন। জাতীয় দলে অভিষেকের পর ঢাকা পোস্টকে তিনি বলছিলেন, ‘আল্লাহর রহমতে এখন আমরা দুই জনই জাতীয় দলের খেলোয়াড়। আমি কয়েক বছর আগেই জাতীয় শুটার হয়েছি। ও (জাকের) জাতীয় দলে প্রবেশের অপেক্ষায় ছিল। অবশেষে ডাক পেয়েছে এবং খেলেছে। এটা আমাদের জন্য দারুণ গর্বের ও ভালো লাগার।’
এয়ার রাইফেল ইভেন্টে নারী বিভাগে বাংলাদেশের অন্যতম ভরসা নাফিসা তাবাসসুম। ২০২২ সালে ইন্দোনেশিয়ার জাকার্তায় গ্র্যা প্রি আইএসএসএফে তিনি ব্যক্তিগত ইভেন্টে ব্রোঞ্জ জিতেছিলেন। মিশ্র ইভেন্টে জয় করেছিলেন রৌপ্য। ২০২৩ সালে চীনের হাংজুতে এশিয়ান গেমসেও খেলেছেন।
ক্রীড়াবিদ হিসেবে অনেকটাই প্রতিষ্ঠিত শুটার নাফিসা তাবাসসুম। জাকের আলীর জন্য এখন নাফিসার নতুন পরিচয় ‘ক্রিকেটার জাকের আলীর স্ত্রী’। নাফিসা এই সম্পর্কে বলছিলেন, ‘আসলে আমরা দুই জনই একে অন্যের পরিচয়ে পরিচিতি পাওয়ার মতো। কেউ বলবে শুটারের স্বামী জাকের আবার জাকেরের স্ত্রী শুটার। দু’টিই উপভোগ্য।’
পরিচয় ও মর্যাদা প্রায় সমান হলেও সুযোগ-সুবিধায় অনেক তারতম্য শুটিং ও ক্রিকেটে। ক্রিকেটাররা কেন্দ্রীয় চুক্তি ও ম্যাচ ফি’র সম্মানী অনেক বেশি পেয়ে থাকেন। আন্তর্জাতিক অঙ্গনে বাংলাদেশি ক্রীড়াবিদদের মধ্যে শুটাররা অন্যদের চেয়ে এগিয়ে। এরপরও তারা থাকেন নিভৃতে। এই প্রসঙ্গে নাফিসার মন্তব্য, ‘আমরা জাতীয় দলে খেলি কয়জন চেনে। আমাদের গেমসগুলো সেভাবে চেনে না। এজন্য মানুষ জানে না।’
বিকেএসপিতে মন দেওয়া নেওয়া
শুটার-ক্রিকেটারের মেলবন্ধনের ক্ষেত্র বাংলাদেশ ক্রীড়া শিক্ষা প্রতিষ্ঠান। জাকের নাফিসার চেয়ে তিন বছরের সিনিয়র। একই সময় বিকেএসপি ক্যাম্পাসে থাকায় মন দেওয়া-নেওয়া। পাঁচ বছর সম্পর্কের পর ২০২০ সালে বিয়ের পিড়িতে বসেন দুই ক্রীড়াবিদ। বিয়ের পর খেলাধুলা চালিয়ে যাওয়া অনেক নারীর পক্ষেই কঠিন। নাফিসার ক্ষেত্রে হয়েছে উল্টো, ‘আমার জাতীয় দলে ভালো পারফরম্যান্সে সবই তো বিয়ের পর। এর অবদান সম্পূর্ণ অনীক ও তার পরিবারের। অনীক না চাইলে তো আর খেলতে পারতাম না।’
অন্য খেলোয়াড়দের তুলনায় ক্রিকেটারদের ব্যস্ততা একটু বেশি। বিপিএল, ঢাকা লিগ ও জাতীয় লিগসহ নানা টুর্নামেন্ট বছর জুড়ে। এর পরও যখন সময়-সুযোগ মিলে জাকের হাজির হন গুলশান শুটিং কমপ্লেক্সে। শুটিংয়ের খুঁটিনাটি বোঝার চেষ্টা করেন। কোচ-খেলোয়াড়দের সঙ্গেও আলাপ-আলোচনা করেন। নাফিসার সূত্রে শুটিং অঙ্গনেও পরিচিত মুখ জাকের।
জাকের যতটা গুলশান আসেন শুটিং দেখতে নাফিসা ততটা মিরপুর যান না ক্রিকেট দেখতে। এরপরও জাকেরের খেলা মাঠ থেকে দেখার সর্বাত্মক চেষ্টা করেন। একদম সম্ভব না হলে চোখ রাখেন টিভির পর্দায়। ক্যারিয়ারের বাকি সময় এভাবেই কাটাতে চান তারা, ‘দোয়া রাখবেন আমরা দুই জন যেন দুই খেলায় আরো মনোযোগ দিয়ে ভালো খেলতে পারি।’
দুই জনই ক্রীড়াবিদ। স্বাভাবিকভাবেই আলোচনা আসে তাদের উত্তরাধিকার এই পথে হাঁটবে কি না? নাফিসা বলছিলেন, ‘পরবর্তী প্রজন্মের বিষয়টি তাদের হাতেই। আমরা এখন আমাদের খেলা নিয়েই পূর্ণ মনোযোগী।’