বণিক বার্তা ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় (ঢাবি) ব্যবসায় শিক্ষা অনুষদের যৌথ উদ্যোগে তিন দিনব্যাপী অষ্টম নন-ফিকশন বইমেলা সোমবার (৩০ ডিসেম্বর) শেষ হয়েছে।
বিশ্ববিদ্যালয়ের ব্যবসায় শিক্ষা অনুষদ প্রাঙ্গণে গত শনিবার (২৮ ডিসেম্বর) থেকে শুরু হওয়া তিন দিনব্যাপী এ মেলার সমাপনী অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথি ছিলেন আইন, বিচার ও সংসদ বিষয়ক মন্ত্রণালয়ের উপদেষ্টা ড. আসিফ নজরুল।
প্রধান অতিথির বক্তব্যে ড. আসিফ নজরুল বলেন, আমাদের নন-ফিকশন বই আরও অনেক বেশি পড়া দরকার। ক্রমান্বয়ে আমরা ফেসবুকের তথ্যনির্ভর জাতিতে পরিণত হয়েছি। নন-ফিকশন বই না থাকলে আমাদের জ্ঞানভিত্তিক সমাজ গড়ে উঠবে না। গত ১৫ বছরে আমাদের জ্ঞানের রাজ্যে যে অনাচার চলেছে, সেটি নিয়ে আমরা বলতে পারি জ্ঞানের রাজ্যে জেনোসাইড (গণহত্যা) হয়েছে।
তিনি আরও বলেন, আমি কিছুদিন সংস্কৃতি মন্ত্রণালয়ের দায়িত্বে থাকাকালে গ্রন্থ কেন্দ্রে গত দুই বছরের ক্রয়কৃত বইয়ের তালিকা চাইলাম। প্রবাসী কল্যাণ মন্ত্রণালয় কী কী বই রাখে, ঘুরে দেখলাম। আশ্চর্যজনকভাবে দেখলাম, সেখানে কেনা বইগুলোর মধ্যে ৯৫ শতাংশই নন-ফিকশন। ৯৫ শতাংশের ৯৫ শতাংশই হচ্ছে বঙ্গবন্ধু, শেখ হাসিনা বা তাদের পরিবারকে নিয়ে। এমনকি বেগম ফজিলাতুন্নেসা মুজিবের ওপরও প্রায় ২০-২৫টা বই আছে। এখানে একটা অনাচার চলেছে। জঘন্য অকথ্যমানের বই কেনা হয়েছে, যেখানে কোনো ধরনের গবেষণা নেই।
এ সময় ভালো গবেষণামূলক বইগুলোকে দমিয়ে রাখার চেষ্টা করা হয়েছে উল্লেখ করে ড. আসিফ নজরুল বলেন, অনেক লেখকের বই নিষিদ্ধ করা হয়েছে। এমনকি উচ্চ আদালতের বিচারক উপন্যাসের ভাষা পরিবর্তন করে দিয়ে বলেছেন যে এভাবে উপন্যাস লেখা যাবে না। উপন্যাস ছাপা হয়ে যাওয়ার পর ভাষা পরিবর্তন করা হয়েছে। মুক্তিযুদ্ধের দ্বিতীয় সর্বাধিনায়ক এ কে খন্দকারের একটা কথাকে কেন্দ্র করে একটি প্রকাশনা উনার বই পুনঃমুদ্রণের সাহস করেনি ৫-৬ বছর। এই যে অনাচার চলেছে জ্ঞানের রাজ্যে, এটিকে মুক্ত করার এক অপূর্ব সুযোগ এনে দিয়েছে আমাদের জুলাই গণঅভ্যুত্থান, ছাত্রনেতা, যুবক, তাদের অভিভাবক ও সর্বস্তরের মানুষেরা। আমরা যেন এটিকে খুব ভালোমতো ব্যবহার করি। আমাদের এখানে যেন অনেক ভালো মানের গবেষণা ও এ ধরনের বইমেলা হয়, সে আশা রাখি।
এবারের মেলায় দেশের মোট ৩৯টি প্রকাশনা ও গবেষণা সংস্থা অংশ নেয়। অংশ নেওয়া প্রকাশকদের মনোনীত বই থেকে বিচারক প্যানেল ২০২৪-এর চারটি নন-ফিকশন বই নির্বাচিত করে ‘নন-ফিকশন গ্রন্থ সম্মাননা ২০২৪’ প্রদান করা হয় গতকাল সমাপনী অনুষ্ঠানে। সম্মাননাপ্রাপ্ত বিজয়ী গ্রন্থ ও লেখকরা হলেন, অধ্যাপক সিরাজুল ইসলাম চৌধুরীর ‘সাতচল্লিশের দেশভাগে গান্ধী ও জিন্নাহ’, সিরাজ উদ্দিন সাথীর ‘বাংলাদেশের বামপন্থী রাজনীতি : মওলানা ভাসানী ও বেহাত বিপ্লব’, অধ্যাপক আনু মুহাম্মদের ‘অর্থশাস্ত্র : ইতিহাস দর্শন রাষ্ট্রনীতি’ এবং প্রয়াত হায়দার আকবর খান রনোর ‘সমাজতন্ত্র ও পুঁজিবাদ : ইতিহাসের পাণ্ডুলিপি’।
অধ্যাপক সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী বলেন, ‘বইয়ের এখন মর্যাদা ও আকর্ষণ কমেছে- সবই সত্য। কিন্তু এটাও সত্য যে, বই ছাড়া মানুষের চলবে না। বই মানুষের মনুষ্যত্ব বিকাশ, চর্চা ও অনুশীলনে সহযোগী। আমরা দেখছি, নন-ফিকশন বই ক্রমাগত মূল্যবান হয়ে উঠছে। এখন অনেক বাণিজ্য বেড়েছে। কিন্তু বাণিজ্যের মধ্যে যে মানবিকতার চর্চা দরকার, এই বইয়ের মেলা আমাদের সে কথাটাই মনে করিয়ে দেয় ‘
অধ্যাপক আনু মুহাম্মদ বলেন, বণিক বার্তা নন-ফিকশন বইমেলা যেটি করে সেটির গুরুত্ব আমরা দিনে দিনে, বছরের পর বছর আরও বুঝতে পারছি। বইয়ের ক্ষেত্রে লেখকদের প্রধান অনুপ্রেরণা হচ্ছে পাঠক। পাঠকরা যদি বই না পড়ে তাহলে লেখকদের কোনো উৎসাহ থাকে না। লিখতে গেলেও অনেক সমস্যা হয়। পাঠকদের কাছে পৌঁছানোটা অনেক কঠিন। বিশেষ করে নন-ফিকশন বই নিয়ে পত্র-পত্রিকায় আলোচনা খুব কম হয়। রিভিউ তো হয়ই না। গ্রন্থ পর্যালোচনা বলে বাংলাদেশে এখন কিছুই হয় না। সব মিলিয়ে এক জটিল পরিস্থিতি। এখানে মিডিয়ার একটি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রয়েছে, যেটি পালন করা দরকার। সরকারেরও কিছু উদ্যোগ নেওয়া দরকার। যেমন জাতীয় গ্রন্থাগার, পাবলিক লাইব্রেরিগুলো যেন ঠিকঠাক বই কেনা বা বই প্রচারের যে দায়িত্ব, সেটি পালন করে।
অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টার মুখ্য সচিব সিরাজ উদ্দিন সাথী বলেন, এখানে আসতে পেরে ব্যক্তিগতভাবে আনন্দিত। আমার ‘মওলানা ভাসানী ও বেহাত বিপ্লব’ বইটি বিচারকদের দৃষ্টি আকর্ষণ করেছে এটি আমার জন্য খুশির বিষয়। আমার এ বইটি লেখা বোধহয় সার্থক হলো। এ বই লেখার অনুপ্রেরণায় ছিলেন অধ্যাপক সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী। জীবনবাজি রেখে যুদ্ধ করে এবং পাকিস্তানি সেনাদের হাতে ধরা পড়া একজন মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে সে সময়টাকে যেভাবে দেখেছি এবং মওলানা ভাসানীর জীবন ইতিহাসকে আমি যেভাবে অধ্যয়ন করেছি, এই দেশে একটা বিপ্লব হতে পারত। মোক্ষম সে সুযোগটি আমাদের হাতছাড়া হয়েছে। সে জন্য ‘বেহাত বিপ্লব’ শব্দটা আমি ব্যবহার করেছি।
তিনি আরও বলেন, আমি মনে করি, মওলানা ভাসানীকে জাতীয়ভাবে মূল্যায়ন করা হচ্ছে না। তার বিশাল ভূমিকা। শৈশব থেকে শুরু করে বাংলা এবং আসামে জাতীয় পর্যায়ে এমন একটি আন্দোলন হয়নি যেখানে মওলানা ভাসানী ছিলেন না। আমি দেখলাম তাকে ইতিহাস থেকে মুছে দেওয়ার চেষ্টা করা হচ্ছে। পাঠ্যপুস্তক থেকে তার নাম মুছে দেওয়া হয়েছে। তার নামে প্রতিষ্ঠিত প্রতিষ্ঠান থেকে তার নাম মুছে দিয়ে অন্য নাম দেওয়া হয়েছে। সে কারণে আমি মওলানা ভাসানীকে নিয়ে লিখেছিলাম। বণিক বার্তার এই আয়োজনের পর আমি আজকে মনে করি, আমার লেখাটা সার্থক হয়েছে। যারা এমন একটি অনুভূতি আমাকে দিলেন, তাদের সবার প্রতি আমি কৃতজ্ঞ।
বণিক বার্তার প্রধান প্রতিবেদক মো. বদরুল আলমের সঞ্চালনায় অনুষ্ঠানের সূচনা বক্তব্য রাখেন বণিক বার্তার সম্পাদক ও প্রকাশক দেওয়ান হানিফ মাহমুদ। ধন্যবাদ জ্ঞাপন করেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ব্যবসায় শিক্ষা অনুষদের ডিন অধ্যাপক ড. মাহমুদ ওসমান ইমাম। অনুষ্ঠানে বিশেষ অতিথির বক্তব্য রাখেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের উপ-উপাচার্য (প্রশাসন) অধ্যাপক ড. সায়মা হক বিদিশা, উপ-উপাচার্য (শিক্ষা) অধ্যাপক ড. মামুন আহমেদ এবং আয়োজনের প্রধান সহযোগী আল-আরাফাহ ইসলামী ব্যাংকের উপব্যবস্থাপনা পরিচালক ও সিওও কাজী মাহমুদ করিম।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের উপ-উপাচার্য (প্রশাসন) সায়মা হক বিদিশা বলেন, বই আমাদের অবসরের সঙ্গী সন্দেহ নেই। পাশাপাশি আমরা যারা ক্লাসরুমে পড়াই আমাদের জন্য নন-ফিকশন বইয়ের আলাদা মাত্রা রয়েছে। পড়ানোর সময় ক্লাসরুমে সীমিত সময়ে তাত্ত্বিক আলোচনার প্রেক্ষিতে খুব বেশি হয়তো প্রায়োগিক বিষয় আলোচনা করার বা ভিন্নমাত্রায় যাওয়ার সুযোগ খুব একটা হয় না। কিন্তু নন-ফিকশন বই শিক্ষার্থীদের পড়াশোনায় গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে। সে কারণে এ ধরনের মেলা একটি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা বহন করে।’
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের উপ-উপাচার্য (শিক্ষা) অধ্যাপক ড. মামুন আহমেদ বলেন, এ ধরনের নন-ফিকশন বই আমাদের বিশ্ববিদ্যালয়ের একাডেমিক এক্সারসাইজের চেয়ে ভিন্ন কিছু মনে করি না। আমি মনে করি, আমরা যে পঠন, পাঠন এবং এক্সারসাইজের মধ্যে থাকি, এ ধরনের আয়োজন আমাদের আরও সমৃদ্ধ করবে। এ আয়োজনের আরও বিস্তৃতি ঘটালে আমাদের শিক্ষার্থীদের সঙ্গে লেখক-প্রকাশকদের সম্মিলন ঘটানো যাবে। এমন আয়োজনের মাধ্যমে আমাদের শিক্ষার্থীদের পাঠ্যাভ্যাস এবং মেন্টাল ফ্যাকাল্টি প্রসারণে আমরা অবদান রাখতে পারব।
বণিক বার্তার সম্পাদক দেওয়ান হানিফ মাহমুদ বলেন, বইমেলা শুরুর সময় আমরা ভাবিনি যে এটা আট বছর চালিয়ে নিতে পারব। লেখক-প্রকাশকদের সঙ্গে কথা বললে তারা সব সময় বলেন, নন-ফিকশন বইয়ের পাঠক পাওয়া যায় না, বই বিক্রি হয় না। কিন্তু আমরা যখন শুরু করি, তখন আমাদের মনে হয়েছে এটি একটি অপার সম্ভাবনাময় দেশ। এ সম্ভাবনাময় দেশকে যদি একটা জ্ঞানভিত্তিক সমাজের দিকে নিয়ে যাওয়া যায় তাহলে দেশ হয়তো বৈশ্বিক জায়গায় একটা অবস্থান করে নিতে পারবে। এমন একটি সুদূরপ্রসারী চিন্তাভাবনা থেকেই এ আয়োজনের সূত্রপাত।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ব্যবসায় শিক্ষা অনুষদের ডিন অধ্যাপক ড. মাহমুদ ওসমান ইমাম বক্তব্যে বলেন, নন-ফিকশন বইমেলা ২০১৫ সাল থেকেই আমাদের ব্যবসায় শিক্ষা অনুষদ এবং বণিক বার্তার যৌথ উদ্যোগে পরিচালিত হয়ে আসছে। তারই ধারাবাহিকতায় এবারও মেলার আয়োজন করা হয়েছে। করোনা মহামারির সময় আমরা করতে পারিনি। ৩৯টির বেশি প্রকাশনী এবারের মেলায় অংশগ্রহণ করেছে। ২৮-৩০ ডিসেম্বর পর্যন্ত এ তিন দিন শিক্ষার্থী ও পাঠকের পদচারণায় এ মেলা ছিল উৎসবমুখর। বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রতিনিধি হিসেবে আমরা এ আয়োজনে গর্বিত, আমরা আনন্দিত।