শান্তিতে নোবেলজয়ী মালালা ইউসুফজাই ১৩ বছর পর গোপনে নিজ গ্রামে ফিরেছেন। পাকিস্তানের খাইবার পাখতুনখোয়া প্রদেশের সোয়াত উপত্যকার শাংলা এলাকায় তিনি সফর করেন। তবে নিরাপত্তার কারণে তার এ সফর ছিল সম্পূর্ণ গোপনীয়।
২০১২ সালের অক্টোবরে তালেবানের গুলিতে আহত হওয়ার পর মালালাকে পাকিস্তান ছাড়তে হয়েছিল। সে সময় স্কুলে যাওয়ার পথে তালেবান বন্দুকধারীরা তার স্কুলবাসে উঠে গুলি চালায়। মাথায় গুলিবিদ্ধ মালালাকে আশঙ্কাজনক অবস্থায় চিকিৎসার জন্য যুক্তরাজ্যে পাঠানো হয়। সেখানে দীর্ঘ চিকিৎসার পর তিনি সুস্থ হন এবং পরবর্তীতে সেখানেই স্থায়ীভাবে বসবাস শুরু করেন।
বর্তমানে ব্রিটিশ নাগরিক মালালা বুধবার (৫ মার্চ) নিজের গ্রামে যান। নিরাপত্তার কথা বিবেচনা করে সফরটি ছিল সম্পূর্ণ গোপনীয়। তিনি সেখানে আত্মীয়দের সঙ্গে দেখা করেন এবং ২০১৮ সালে প্রতিষ্ঠিত একটি কলেজ পরিদর্শন করেন, যেখানে মেয়েদের বিনামূল্যে শিক্ষা দেওয়া হয়।
এ সফরের বিষয়ে তিনি নিজেই পরে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে জানিয়েছেন। সোশ্যাল মিডিয়ায় শেয়ার করা এক ছবিতে তাকে তুষারাবৃত পাহাড় ও নদীর সামনে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখা যায়।
ছবির ক্যাপশনে মালালা লিখেছেন, ১৩ বছর পর নিজ গ্রামে ফিরে আসা আমার জন্য আনন্দের বিষয়। ছোটবেলায় প্রতি ছুটিতে আমি শাংলা নদীর পাশে খেলতাম, পরিবারের সঙ্গে খাওয়া-দাওয়া করতাম। পাহাড়ের মাঝে থাকার অনুভূতি, ঠান্ডা নদীর পানিতে হাত ডুবানোর মুহূর্তগুলো অমূল্য। আশা করি আবারও এখানে আসতে পারব।
মালালার সফরের সময় তার বাবা ও স্বামী সঙ্গে ছিলেন। তিনি হেলিকপ্টারে করে গ্রামে পৌঁছান। সফরকালীন নিরাপত্তা ব্যবস্থা কঠোর করা হয়েছিল, কিছু এলাকায় চলাচল সীমিত রাখা হয়। পাকিস্তানের এক সরকারি কর্মকর্তা সংবাদ সংস্থা এএফপিকে জানান, কোনো অনাকাঙ্ক্ষিত ঘটনা এড়াতে সফরটি গোপন রাখা হয়েছিল এবং স্থানীয়রাও তার আগমনের বিষয়ে জানতেন না।
উল্লেখ্য, মালালা ১৯৯৭ সালের ১২ জুলাই সোয়াত উপত্যকার মিনগোরায় জন্মগ্রহণ করেন। বাবা জিয়াউদ্দিন ইউসুফজাই একজন শিক্ষাবিদ, যিনি মেয়েদের শিক্ষার পক্ষে ছিলেন। ২০০৭ সালে তালেবান সোয়াত দখল করলে মেয়েদের শিক্ষা নিষিদ্ধ করে এবং বহু স্কুল ধ্বংস করে।
তখন মাত্র ১১ বছর বয়সী মালালা গুল মাকাই ছদ্মনামে বিবিসি উর্দুর জন্য একটি ডায়েরি লিখতেন, যেখানে তিনি তালেবানের শাসনে জীবনযাত্রার অভিজ্ঞতা তুলে ধরেন। তার লেখা আন্তর্জাতিক সংবাদমাধ্যমের নজর কাড়ে।
২০১২ সালে তালেবান মালালাকে হত্যার চেষ্টা চালায়, কিন্তু তিনি বেঁচে যান এবং যুক্তরাজ্যে আশ্রয় নেন। পরে নারী শিক্ষার জন্য কাজ চালিয়ে যাওয়ায় ২০১৪ সালে শান্তিতে নোবেল পুরস্কার লাভ করেন।
নিজ গ্রামে সফরকালে মালালা একটি কলেজ পরিদর্শন করেন এবং শিক্ষার্থীদের সঙ্গে কথা বলেন। পাকিস্তানের উচ্চপদস্থ পুলিশ কর্মকর্তা আমজাদ আলম খান বলেন, মালালা শিক্ষার্থীদের পড়াশোনায় মনোযোগী হতে বলেছেন এবং তাদের উজ্জ্বল ভবিষ্যতের জন্য উৎসাহিত করেছেন। পাশাপাশি, তিনি ঘোষণা দিয়েছেন যে, ‘মালালা ফান্ড’ এই কলেজে বিনামূল্যে উচ্চমানের শিক্ষা নিশ্চিত করতে সহায়তা করবে।
পাকিস্তানের বান্নু এলাকায় সামরিক ছাউনিতে দুটি আত্মঘাতী বোমা হামলায় ১৩ বেসামরিক নাগরিক ও পাঁচ নিরাপত্তাকর্মী নিহত হওয়ার ঘটনায় দুঃখ প্রকাশ করেন মালালা। পাকিস্তানি তালেবানের সঙ্গে যুক্ত একটি সন্ত্রাসী গোষ্ঠী হামলার দায় স্বীকার করেছে। এতে ৪২ জন আহত হয়েছেন, যাদের মধ্যে কয়েকজনের অবস্থা আশঙ্কাজনক।
এ নিয়ে মালালা বলেন, আমাদের সুন্দর দেশে শান্তি প্রতিষ্ঠার জন্য আমি প্রার্থনা করি। বান্নুর সাম্প্রতিক হামলাসহ এসব ঘটনা হৃদয়বিদারক। নিহতদের পরিবারের প্রতি আমার সমবেদনা রইল এবং আমার দেশের প্রতিটি মানুষের নিরাপত্তার জন্য আমি প্রার্থনা করি।
গত ১৩ বছরে পাকিস্তানে কয়েকবার এলেও এবারই প্রথম নিজ গ্রামে ফিরলেন মালালা। তালেবানের হামলার শিকার হওয়ার পর থেকে এতদিন তিনি তার জন্মস্থানে যেতে পারেননি। নিরাপত্তা হুমকির কারণে সফরটি ছিল গোপনীয়, কিন্তু এত বছর পর শৈশবের স্মৃতিবিজড়িত গ্রামে ফিরে আসার অনুভূতি তিনি নিজের বক্তব্যে স্পষ্ট করেছেন।
মালালার এই সফর তার জীবনযাত্রার একটি গুরুত্বপূর্ণ অধ্যায় হয়ে থাকবে, যা নারী শিক্ষার প্রতি তার প্রতিশ্রুতি ও সংগ্রামের প্রতিফলন ঘটায়।