মাগুরার বহুল আলোচিত তৃতীয় শ্রেণির ছাত্রী আছিয়া ধর্ষণ ও হত্যা চেষ্টার ৮ দিন পর বৃহস্পতিবার দুপুরে ঢাকা সিএমএইচে মারা যায়। ওই দিন সন্ধ্যায় তার লাশ সেনাবাহিনীর হেলিকপ্টারযোগে মাগুরায় নেওয়া হয়। সন্ধ্যায় মাগুরা নোমানী ময়দান ও নিজ গ্রামে জানাজা শেষে তাকে সোনাইকুন্ডি ঈদগাহ সংলগ্ন গোরস্তানে দাফন করা হয়।
এ ঘটনায় শুক্রবার (১৪ মার্চ) সকালেও শ্রীপুর উপজেলার সব্দালপুর ইউনিয়নের জারিয়া গ্রামে নিহতের বাড়িতে চলছে শোকের মাতম।
সকালে বিভিন্ন সামাজিক রাজনৈতিক সংগঠনের নেতাকর্মীরা আছিয়ার পরিবারের সঙ্গে দেখা করেন। বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারপারসন তারেক রহমানের পক্ষ থেকে আছিয়ার মায়ের হাতে নগদ অর্থ প্রদান করেন জাতীয়তাবাদী মহিলা দলের সভানেত্রী আফরোজা আব্বাস।
এ সময় আফরোজা আব্বাস বলেন, বিগত সরকারের আমলে একটিও ধর্ষণের ঘটনার বিচার হয়নি। বিচারহীনতার এই সংস্কৃতি থেকে বেরিয়ে এসে বর্তমান ড. ইউনূসের অন্তর্বর্তীকালীন সরকার দ্রুত বিচারের মাধ্যমে এ ঘটনার একটি দৃষ্টান্ত স্থাপন করবে।
এর মধ্য দিয়ে বিচারহীনতার সংস্কৃতি বন্ধ হবে বলে তিনি আশা প্রকাশ করেন। এ সময় তার সঙ্গে অন্যদের মধ্যে উপস্থিত ছিলেন মহিলা দলের কেন্দ্রীয় নেত্রী সাবেক সংরক্ষিত সংসদ সদস্য নেওয়াজ হালিমা আরলি, জেলা বিএনপির সদস্য সচিব মনোয়ার হোসেন খানসহ অন্যরা।
এদিকে শুক্রবার বিকেলে নিহত আছিয়ার বড় বোন হামিদা খাতুনকে অসুস্থ অবস্থায় মাগুরা শহরের একটি বেসরকারি ক্লিনিকে চিকিৎসা দেওয়া হয়। সেখানে চিকিৎসক সুমি আক্তার তার শারীরিক অবস্থা পর্যবেক্ষণ করেন।
তিনি বলেন, হামিদা বর্তমানে মানসিক ট্রমার মধ্যে আছে। তার বুকের দুপাশেই ওপরে ব্লেড দিয়ে কাটার বেশ কিছু চিহ্ন পাওয়া গেছে। তবে সেগুলোতে এখন আর কোনো ইনফেকশন নেই। সামান্য ওষুধেই সেরে যাবে। তবে তার মেন্টাল কাউন্সিলিং দরকার।
এর আগে বৃহস্পতিবার সন্ধ্যায় মাগুরা নোমানী ময়দানে আছিয়ার প্রথম জানাজায় অন্যদের মধ্যে উপস্থিত ছিলেন- ঢাকা মহানগর দক্ষিণ যুবদলের সদস্য সচিব মাগুরার সন্তান রবিউল ইসলাম নয়ন, সদ্য গঠিত জাতীয় নাগরিক পার্টির কেন্দ্রীয় নেতা হাসনাত আব্দুল্লাহ, সারজিস আলম, খেলাফত মজলিসের চেয়ারম্যান মওলানা মামুনুল হকসহ অন্যরা।
পরে তার লাশ নিজগ্রাম শ্রীপুর উপজেলার জারিয়াতে নিয়ে যাওয়া হয়। রাত ৯টার দিকে আছিয়ার লাশ সোনাইকুন্ডি ঈদগাহসংলগ্ন গোরস্তানে দাফন করা হয়। এ সময় সেখানে উপস্থিত ছিলেন- পুলিশের খুলনা রেঞ্জ ডিআইজি মো. রেজাউল হক, মাগুরার জেলা প্রশাসক অহিদুল ইসলাম, পুলিশ সুপার মিনা মাহমুদাসহ কর্মকর্তারা।
নিহতের মা-বাবা, খালা, ফুপুসহ এলাকাবাসী বারবার কান্নায় ভেঙে পড়ছে। বিভিন্ন এলাকা থেকে শত শত উৎসুক জনতা নিহত আছিয়ার বাড়িতে ভিড় করছে। এ সময় তারা আছিয়ার ধর্ষণ ও হত্যার বিচার দাবি করেন।
আছিয়ার মা বলেন, গত ২ মার্চ আছিয়া তার বড় বোনের সঙ্গে তার শ্বশুরবাড়ি মাগুরার নিজনান্দুআলী গ্রামে যায়। সেখানে ৬ মার্চ ভোররাতে মেয়ের শ্বশুর হিটু শেখ (৪৫), স্বামী সজিব শেখ (১৮) ও ভাশুর রাতুল শেখ (২০) তার ওপর অমানবিক অত্যাচার চালায়। তিনি আশঙ্কা করেন ওই সময় আসিয়ার বড় বোনকে ওষুধ খাইয়ে ঘুম পাড়িয়ে রাখা হয়েছিল। বর্বরোচিত এ কাজে হিটু শেখের স্ত্রী জায়েদা খাতুন সহযোগিতা করেছেন বলে দাবি করেন তিনি। তিনি অবিলম্বে দায়ীদের বিচার করে ফাঁসির দাবি জানান।
এদিকে আছিয়ার প্রথম জানাজা শেষ হওয়ার পরই বৃহস্পতিবার রাতে বিক্ষুব্ধ এলাকাবাসী নৃশংসতম এ ঘটনার সঙ্গে জড়িত থাকায় অভিযুক্ত হিটু শেখের বাড়িতে আগুন লাগিয়ে ও হাতুড়ি দিয়ে ভেঙে গুঁড়িয়ে দেয়। তারা বলেন, পিতা-পুত্র মিলে শিশু ধর্ষণ ও হত্যাকাণ্ডের ইতিহাসের নৃশংসতম অমানবিক এমন ঘটনা তাদের বিক্ষুব্ধ করে তুলেছে। এ ধরনের অপরাধের সঙ্গে জড়িতদের নাম-নিশানা মুছে ফেলা উচিত। সে কাজই তারা করছেন।
এ ঘটনায় ৬ মার্চ ধর্ষণে অভিযুক্ত হিট্টু শেখকে গ্রেপ্তার করে পুলিশ। ৭ মার্চ তার দুই ছেলে সজীব ও রাতুলকে গ্রেপ্তার করা হয়। ৮ মার্চ বিক্ষুব্ধ জনতার দাবির মুখে হিটু শেখের স্ত্রী জায়েদা খাতুনকে গ্রেপ্তার করে পুলিশ। ওই দিন দুপুরে গ্রেপ্তার চারজনকে আসামি করে মাগুরা সদর থানায় একটি মামলা করেন নিহত আছিয়ার মা।
এদিকে ন্যক্কারজনক এ ঘটনা বিভিন্ন মিডিয়ায় প্রচার হওয়ার পর থেকে মাগুরাসহ সারা দেশে ধর্ষণবিরোধী ব্যাপক জনমত তৈরি হয়। অধিকাংশ জেলা, উপজেলা ও শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে ধর্ষণবিরোধী মানববন্ধন, মিছিল-মিটিংয়ে সারা দেশ উত্তাল হয়ে ওঠে। বিক্ষোভকারীরা ‘তুমি কে আমি কে, আছিয়া আছিয়া’, ‘উই ওয়ান্ট জাস্টিস, জাস্টিস ফর আসিয়া’ ইত্যাদি স্লোগানে স্লোগানে ঘৃণিত এ ধর্ষকদের ও তাদের সহযোগীদের সর্বোচ্চ শাস্তি নিশ্চিত করার দাবি জানান। এ ঘটনার সঙ্গে জড়িতদের ২৪ ঘণ্টার মধ্যে বিচার শেষ করে ফাঁসির দাবি ওঠে সারা দেশে। তবে শুক্রবার মাগুরায় যানচলাচল স্বাভাবিক ছিল, কোথাও কোনো অপ্রীতিকর ঘটনা ঘটেনি।