খ্রিস্টান ধর্মাবলম্বীদের সর্বোচ্চ আধ্যাত্মিক নেতা এবং সার্বভৌম নগররাষ্ট্র ভ্যাটিকান সিটির সরকার প্রধান পোপ ফ্রান্সিসের মৃ্ত্যু শোকের আবহ বয়ে এনেছে আন্তর্জাতিক বিশ্বে। বহু দেশের রাষ্ট্র ও সরকারপ্রধান তার মৃত্যুতে শোকবার্তা দিয়েছেন।
গুরুতর নিউমোনিয়ায় আক্রান্ত হয়ে আজ ২১ এপ্রিল সোমবার স্থানীয় সময় সকাল ৭ টা ৩৫ মিনিটে শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন পোপ ফ্রান্সিস। মৃত্যুকালে তার বয়স হয়েছিল ৮৮ বছর।
ভ্যাটিকান সিটির প্রশাসন এক ভিডিওবার্তায় তার মৃত্যুর সংবাদ নিশ্চিত করার পর যুক্তরাষ্ট্রের ভাইস প্রেসিডেন্ট জে ডি ভ্যান্স এক শোকবার্তায় বলেন, “এই মাত্র পোপ ফ্রান্সিসের মৃত্যুর সংবাদ পেলাম। গতকাল (রোববার) তার সঙ্গে সাক্ষাৎ করতে গিয়েছিলাম। তিনি খুবই অসুস্থ ছিলেন বলে তা আর হয়নি।”
“তাকে সবসময়ে আমার মনে পড়বে। করোনা মহামারির শুরুর দিন গুলোতে গোটা বিশ্ব যখন আতঙ্কে অস্থির, সে সময় তিনি প্রতিদিন আমাদের শান্ত থাকার জন্য যেসব ধর্মপোদেশ দিতেন, তা আমি কখনও ভুলব না। তার মৃত্যুতে বিশ্বজুড়ে কোটি কোটি খ্রিস্টান ধর্মাবলম্বীদের মতো আমার হৃদয়ও ভারাক্রান্ত।”
পোপ ফ্রান্সিসকে ‘একজন মহান ব্যক্তি এবং মহান নেতা’ উল্লেখ করে এক শোক বার্তায় ইতালির প্রধানমন্ত্রী জর্জিয়া মেলোনি বলেন, “আমার সৌভাগ্য হয়েছিল তার সান্নিধ্যে আসার, বন্ধুত্ব অর্জনের। যে উপদেশ, যে শিক্ষা আমি তার কাছ থেকে পেয়েছি— জীবনের কঠিনতম সময়ে সেসব ছিল আমার পাথেয়।
এক শোকবার্তায় ফ্রান্সের প্রেসিডেন্ট ইমানুয়েল ম্যাক্রোঁ জানিয়েছেন, “যতদিন তিনি পোপ ছিলেন, সবসময় তিনি দুর্বল ও অসহায়ের পক্ষে অবস্থান নিয়েছেন। তার বিনম্র, নিরহঙ্কারপূর্ণ আচরণের অসংখ্য উদাহারণ রয়েছে। যুদ্ধ ও সহিংসতায় পরিপূর্ণ এই বিশ্বে তিনি সারাজীবন দুর্বল, নিপীড়িতের কথা চিন্তা করেছেন, তাদের কল্যাণে নিজেকে উৎসর্গ করেছেন।”
ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ মোদি পোপ ফ্রান্সিসকে নম্রতা, সহানুভূতি এবং আধ্যাত্মিক সাহসিকতার বাতিঘর উল্লেখ করে এক শোকবার্তায় বলেন, “তিনি নিরলসভাবে দরিদ্র ও নিপীড়তদের সেবা করে গেছেন। দুঃখ-কষ্টে থাকা লোকজনের মনে আশার আলো জাগিয়ে তুলতেন তিনি। তার সঙ্গে আমার কয়েবার সাক্ষাৎ হয়েছে এবং সেসব বৈঠকে তিনি অন্তর্ভুক্তিমূলক ও সুষম উন্নয়ন ইস্যুতে যেসব কথা বলেছিলেন, সেসব সবসময় আমাকে অনুপ্রেরণা দেয় এবং ভবিষ্যতেও দেবে। ভারতের জনগণের প্রতি তার ভালবাসা আমরা সবসময় স্মরণে রাখব। ঈশ্বরের সান্নিধ্যে তার আত্মা চিরশান্তি লাভ করুক।”
জর্মানির সম্ভাব্য চ্যান্সেলর ফ্রেডরিখ মের্জ সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম এক্সে পোস্ট করা এক বার্তায় বলেছেন, “সমাজের সবচেয়ে দুর্বল-অসহায় লোকজনের কল্যাণের প্রতি দৃষ্টি ছিল তার। নিজেকে চিরদিন বিশ্বাস ও বিনম্রতার সঙ্গে নিজেকে চিরদিন ঈশ্বরের করুণার পথে চালিত করেছেন তিনি।”
ইসরায়েলের প্রেসিডেন্ট ইসাক হেরজগ সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম এক্সে এক শোকবার্তায় বলেছেন, “তিনি ছিলেন গভীরভাবে ঈশ্বরবিশ্বাসী এবং সীমাহীন সহানুভূতিসম্পন্ন একজন মানুষ। দরিদ্রদের উন্নয়ন এবং অশান্তিপূর্ণ বিশ্বের শান্তি স্থাপনের জন্য গোটা জীবনকে উৎসর্গ করেছেন তিনি। বিশেষ করে মধ্যপ্রাচ্যের জনগণের জন্য তিনি যত প্রার্থনা করেছেন, আমি সত্যিই চাই তার সেসব প্রার্থনা যেন সফল হয়।”
ফিলিপাইনের শীর্ষ ধর্মযাজক এবং কার্ডিনাল পাবলো ভিরিগিলিও ডেভিড বলেন, “ওহ ঈশ্বর! আমি (তার মৃত্যুতে) বিহ্বল, শোকস্তব্ধ।”
ভ্যাটিকানের দাপ্তরিক ওয়েবসাইট ‘দি হোলি সি’–এর তথ্যমতে, পোপ ফ্রান্সিসের আগের নাম জর্জ মারিও বারগোগ্লিও। জন্ম ১৯৩৬ সালের ১৭ ডিসেম্বর, আর্জেন্টিনার বুয়েনস এইরেসের। বাবা মারিও আর রেগিনা সিভোরি। ইতালীয় অভিবাসী বাবা মারিও ছিলেন রেলওয়ের হিসাবরক্ষক।
রসায়নবিদ হিসেবে প্রশিক্ষণ নেওয়ার পর ধর্মের পথে পা বাড়ান জর্জ মারিও। পরবর্তী সময়ে তিনি দর্শন ও ধর্মতত্ত্বে পড়াশোনা করেন। ১৯৬৯ সাল ধর্মযাজক হন। ১৯৯৮ সালে আর্জেন্টিনায় আর্চবিশপ হন তিনি।
বয়স ও শারীরিক অসুস্থতার কারণে ২০১৩ সালে তৎকালীন পোপ ষোড়শ বেনেডিক্ট পদ ছেড়ে দিলে পোপ নির্বাচিত হন জর্জ মারিও। নতুন নাম নেন ফ্রান্সিস। দক্ষিণ আমেরিকার কোনো দেশ থেকে নির্বাচিত প্রথম পোপ তিনি।
পোপ ফ্রান্সিস যখন দায়িত্ব নেন, ক্যাথলিক চার্চ তখন যৌন কেলেঙ্কারি আর ভ্যাটিকান প্রশাসনের কোন্দলে ক্ষতবিক্ষত। তিনি পরিবর্তনের ম্যান্ডেট নিয়ে আসেন এবং চেষ্টা করেন শৃঙ্খলা ফিরিয়ে আনতে।
তবে রক্ষণশীলদের সমালোচনার তীরে তাকে বিদ্ধ হতে হয়েছে বার বার। চার্চের ঐতিহ্য ধ্বংসের অভিযোগও তার বিরুদ্ধে আনা হয়েছে। আবার অনেকে অভিযোগ করেছেন, পরিবর্তনের প্রতিশ্রুতি দিলেও যথেষ্ট পরিবর্তন তিনি আনতে পারেননি।
এর মধ্যেও পোপ ফ্রান্সিস বিশ্বজুড়ে জনপ্রিয়তা অর্জন করেন। বহু দেশ সফর করে আন্তঃধর্মীয় সংলাপ ও শান্তির বার্তা তিনি ছড়িয়ে দিয়েছেন। প্রান্তিক জনগোষ্ঠী এবং অভিবাসীদের পক্ষে তিনি ছিলেন সরব।
পোপ ফ্রান্সিস বলতেন, ক্যাথলিক গির্জার দরজা সবার জন্য খোলা। এমনকি সমকামী, উভকামী ও রূপান্তরকামীদের (এলজিবিটি) গির্জায় আসতে বাধা নেই। তাঁরা গির্জায় এসে প্রার্থনা করতে পারবেন। তবে, তাঁদের গির্জার নিয়মনীতি মেনে চলতে হবে।
এ বছরের জানুয়ারিতে প্রকাশনা প্রতিষ্ঠান পেঙ্গুইন র্যানডম হাউস থেকে প্রকাশিত হয়েছে পোপ ফ্রান্সিসের আত্মজীবনী ‘হোপ’।