চলমান রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধে বিরতি এবং ইউক্রেনের যেসব অঞ্চল ইতোমধ্যে রাশিয়া দখল করেছে, কূটনৈতিক পন্থায় সেসব পুনরুদ্ধারের পক্ষে অবস্থান নিয়েছে যুক্তরাষ্ট্রের নেতৃত্বাধীন সামরিক জোট নর্থ আটলান্টিক ট্রিটি অ্যালায়েন্স (ন্যাটো)।
বুধবার মার্কিন সংবাদমাধ্যম ব্লুমবার্গে প্রকাশিত এক প্রতিবেদনের বরাতে জানা গেছে এ তথ্য। প্রসঙ্গত, ন্যাটো এই যুদ্ধে ইউক্রেনের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ মিত্রদের মধ্যে অন্যতম। ২০২২ সালের ফেব্রুয়ারির শেষ দিকে যুদ্ধ শুরুর পর থেকে এ পর্যন্ত ইউক্রেনকে শত শত কোটি ডলারের সামরিক সহায়তা দিয়ে যাচ্ছে এই জোট।
তবে গত নভেম্বরের নির্বাচনে যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে ডোনাল্ড ট্রাম্প বিজয়ী হওয়ার পর সার্বিক পরিস্থিতিতে পরিবর্তন এসেছে। ইউক্রেন ইস্যুতে কী নীতি অবলম্বন করবেন— সে সম্পর্কে এখনও স্পষ্টভাবে কিছু বলেননি ট্রাম্প, তবে নির্বাচনের আগে বেশ কয়েকবার বলেছেন যে এই যুদ্ধে ওয়াশিংটন- যেভাবে আর্থিক ও সামরিক সহায়তা দিচ্ছে— তিনি তার বিরোধী।
চলতি সপ্তাহে বেলজিয়ামের রাজধানী ব্রাসেলসে ন্যাটোর সদস্যরাষ্ট্রগুলোর পররাষ্ট্রমন্ত্রীদের বৈঠক হয়েছে। সূত্রের বরাতে জানা গেছে, সে বৈঠকের আলোচ্যসূচিতে ইউক্রেনকে সামরিক সহায়তা প্রদান এবং যুদ্ধবিরতি ও মস্কো-কিয়েভের মধ্যে কূটনৈতিক তৎরতা— দুই ইস্যুকেই সমান গুরুত্ব দেওয়া হয়েছে।
বৈঠকে উপস্থিত এক পররাষ্ট্রমন্ত্রী বিষয়টি স্বীকার করে নিয়ে ব্লুমবার্গকে বলেন, “আমরা এই মর্মে একমত হয়েছি যে ইউক্রেনের সার্বিক অবস্থা এখন ভঙ্গুর এবং শিগগিরই (মস্কোর সঙ্গে) কিয়েভের সংলাপ শুরু করা উচিত।”
ব্রাসেলসের বৈঠকে উপস্থিত ছিলেন যুক্তরাষ্ট্রের পলিসি বিষয়ক থিংকট্যাঙ্ক সংস্থা র্যান্ডের জ্যেষ্ঠ বিশ্লেষক স্যামুয়েল শারাপও। ব্লুমবার্গকে তিনি বলেন, “এমনকি যুক্তরাষ্ট্র এবং ন্যাটো যদি ইউক্রেনকে সামরিক সহায়তা প্রদান অব্যাহতও রাখে, তবুও ইউক্রেনের উচিত হবে যত শিগগির সম্ভব যুদ্ধবিরতির সংলাপে অংশ নেওয়া। কারণ যুদ্ধের শুরু থেকে এ পর্যন্ত যে পরিমাণ জনবল হারিয়েছে ইউক্রেনীয় বাহিনী, তাতে আরও ছয় মাস তাদের পক্ষে যুদ্ধ চালিয়ে যাওয়া এক কথায় অসম্ভব।”
উল্লেখ্য, ২০২২ সালের ২৪ ফেব্রুয়ারি যুদ্ধ শুরুর ১৫ দিন পর বেলারুশে প্রথম যুদ্ধবিরতির সংলাপ শুরু হয় মস্কো-কিয়েভের প্রতিনিধিদের মধ্যে। কিন্তু কয়েকদিনের মধ্যেই তা ব্যর্থ হয়। পরে ২০২৩ সালে ফের দু’পক্ষের মধ্যে সংলাপ শুরুর উদ্যোগ নেয় তুরস্ক এবং সেটিরও একই পরিণতি হয়। এর পর জেলেনস্কি একটি একটি প্রেসিডেন্সিয়াল ডিক্রি জারি করেন। সেই ডিক্রিতে উল্লেখ ছিল যে যতদিন পুতিন রাশিয়ার ক্ষমতায় থাকবেন, ততদিন মস্কোর সঙ্গে কোনো শান্তি সংলাপ বা সমঝোতায় যাবে না কিয়েভ।
তবে সম্প্রতি এ ইস্যুতে অবস্থান পরিবর্তনের আভাস দিয়েছেন জেলেনস্কি। যুক্তরাজ্যের স্কাই টিভিকে দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে তিনি বলেছেন, যদি ইউক্রেনকে ন্যাটোর সদস্যপদ দেওয়া হয়— সেক্ষেত্রে তিনি যুদ্ধবিরতি এবং কূটনৈতিক পন্থা অনুসরণের পক্ষে রয়েছেন। তবে তিনি বলেছেন, ইউক্রেনের যেসব এলাকা রাশিয়া দখল করেছে, সেগুলোকে রুশ ভূখণ্ড হিসেবে স্বীকৃতি দেওয়া কিয়েভের পক্ষে অসম্ভব।
ক্রিমিয়াকে রুশ ভূখণ্ড হিসেবে স্বীকৃতি দেওয়ার প্রতিশ্রুতি দিয়েও তা পালন না করা এবং যুক্তরাষ্ট্রের নেতৃত্বাধীন সামরিক জোট ন্যাটোর সদস্যপদের কিয়েভের তদবিরের জেরে কয়েক বছর টানাপোড়েন চলার পর ২০২২ সালের ফেব্রুয়ারি থেকে ইউক্রেনে অভিযান শুরু করে রুশ বাহিনী। রাশিয়ার প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিন নিজে এ অভিযানের নির্দেশ দিয়েছিলেন।
গত তিন বছরের যুদ্ধে দোনেৎস্ক, লুহানস্ক, ঝাপোরিজ্জিয়া এবং খেরসন— ইউক্রেনের এই চার প্রদেশের দখল নিয়েছে রুশ বাহিনী। ২০২২ সালের সেপ্টেম্বরে চার প্রদেশকে রুশ ভূখণ্ড হিসেবে স্বীকৃতিও দিয়েছে মস্কো।
এদিকে ওই একই মাসে ন্যাটোর সদস্যপদের জন্য আবেদন করে কিয়েভ; কিন্তু ন্যাটোর পক্ষ থেকে পরিষ্কার জানিয়ে দেওয়া হয় যে যুদ্ধ শেষ হওয়ার আগ পর্যন্ত ইউক্রেনকে সদস্যপদ দেওয়া সম্ভব নয়।
এদিকে এর কিছুদিন পর মস্কোর পক্ষ থেকে কিয়েভকে প্রস্তাব দেওয়া হয় যে যদি ইউক্রেন আনুষ্ঠানিক ও সাংবিধানিকভাবে ক্রিমিয়া, দোনেৎস্ক, লুহানস্ক, ঝাপোরিজ্জিয়া ও খেরসনকে রুশ ভূখণ্ড হিসেবে স্বীকৃতি দেয়, তাহলে ইউক্রেনে যুদ্ধ বন্ধ করবে রুশ বাহিনী।
এর পাল্টা জবাবে জেলেনস্কি বলেন, রাশিয়া যদি এই ৫ অঞ্চল ইউক্রেনকে ফিরিয়ে দেয় এবং নিজেদের সেনা প্রত্যাহার করে নেয়, তাহলে তিনি যুদ্ধবিরতির সংলাপ শুরু করতে রাজি আছেন।
স্বাভাবিকভাবেই রাশিয়ার তার প্রস্তাব মেনে নেয়নি। ফলে রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধে এ পর্যন্ত বিরতিও আসেনি।