দলিল রেজিস্ট্রেশন, তল্লাশি ও নকল উত্তোলনসহ অন্যান্য কাজে সেবা প্রার্থীদের হয়রানি এবং ঘুষ দাবিসহ বিভিন্ন দুর্নীতির অভিযোগে দেশের ৩৫টি সাব-রেজিস্ট্রার অফিসে অভিযান পরিচালনা করেছে দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক)। অভিযানে সাব-রেজিস্ট্রার অফিসের নকলনবিশ, অফিস সহকারী কিংবা দালালের নিকট থেকে ঘুষের টাকা উদ্ধার থেকে শুরু করে সেবা পেতে নানা অনিয়ম ও অসঙ্গতির সত্যতা মিলেছে।
বুধবার (১৬ এপ্রিল) দুদকের বিভিন্ন অফিস থেকে এনফোর্সমেন্ট টিম এই অভিযান পরিচালনা করে বলে জানা গেছে। সংস্থাটির জনসংযোগ কর্মকর্তা আকতারুল ইসলাম ঢাকা পোস্টকে বিষয়টি নিশ্চিত করেছেন।
তিনি বলেন, মূলত সাব-রেজিস্ট্রার অফিসের দলিল রেজিস্ট্রেশন, তল্লাশি, নকল উত্তোলনসহ অন্যান্য কাজে প্রার্থীদের হয়রানি ও ঘুষ দাবিসহ নানা অনিয়ম এবং দুর্নীতির অভিযোগে একযোগে দেশের ৩৫টি সাব-রেজিস্ট্রার অফিসে অভিযান পরিচালনা করে দুদকের বিভিন্ন এনফোর্সমেন্ট টিম। অভিযানে অধিকাংশ অভিযোগের সত্যতা পাওয়া গেছে। যেসব অভিযোগে কর্মকর্তা-কর্মচারীদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থাও নেওয়া হয়েছে।
অভিযানে যত অনিয়ম ও দুদকের ব্যবস্থা
দিনাজপুরের চিরিরবন্দর সাব-রেজিস্ট্রারের কার্যালয়ে অভিযান পরিচালনাকালে একজন নকলনবিশের নিকট থেকে ২৪ হাজার টাকা ও একজন অফিস সহকারীর নিকট হতে ১১ হাজার ৫০০ টাকা হাতেনাতে উদ্ধার করা হয়। টাকার বিষয়ে কোনো সদুত্তর দিতে না পারায় নকলনবিশকে সাময়িক বরখাস্ত এবং অফিস সহকারীর বিরুদ্ধে তদন্তপূর্বক ব্যবস্থা নেওয়া হবে বলে জেলা রেজিস্ট্রার টিমকে আশ্বস্ত করা হয়েছে।
কুষ্টিয়ার খোকসা সাব-রেজিস্ট্রারের কার্যালয়ে নাইট গার্ডের নিকট হতে ৪০ হাজার টাকা পাওয়া যায়, যার সন্তোষজনক ব্যাখ্যা তিনি দিতে পারেননি। এ ছাড়া অফিস কার্যক্রমে অনিয়ম ও অসঙ্গতির সত্যতা পাওয়া যায়।
গোপালগঞ্জের কোটালীপাড়া সাব-রেজিস্ট্রারের কার্যালয়ে সরকার নির্ধারিত ফির অতিরিক্ত অর্থ আদায়, ৫২(খ) রশিদ বহিতে গরমিল এবং মোহরারদের দ্বারা দলিল প্রতি ১ হাজার ৯০০ থেকে ২ হাজার টাকা পর্যন্ত আদায়ের প্রমাণ পাওয়া যায়।
সিলেটের গোয়াইনঘাট সাব-রেজিস্ট্রারের কার্যালয়ে আবাসিক ভূমি রেজিস্ট্রেশন, নকল উত্তোলনসহ প্রতিটি ধাপে ঘুষ লেনদেনের তথ্য সেবাগ্রহীতাদের সাক্ষ্যে উঠে আসে। একজন ভুক্তভোগী জানান, একটি দলিল সম্পন্ন করতে তাকে ৪০ হাজার টাকা ঘুষ দিতে হয়েছে।
যশোর সদর সাব-রেজিস্ট্রারের কার্যালয়ের অফিস সহকারীর টেবিল থেকে ৫ হাজার ১০০ টাকা উদ্ধার করা হয়। যার উৎস সম্পর্কে তিনি কোনো সদুত্তর দিতে পারেননি। এছাড়া, এক নকলনবিশ পূর্বে আত্মসাতের অভিযোগে সাময়িক বরখাস্ত হয়েছিলেন।
খুলনা সদরের সাব-রেজিস্ট্রারের কার্যালয়ে ছদ্মবেশে অভিযান চালিয়ে ঘুষ গ্রহণ, অতিরিক্ত অর্থ আদায়, রেকর্ডপত্রে অসঙ্গতি এবং দালালদের সক্রিয়তা প্রাথমিকভাবে প্রমাণিত হয়। কয়েকজনকে জেলা রেজিস্ট্রার বরাবর ব্যবস্থা গ্রহণের জন্য সোপর্দ করা হয়।
ময়মনসিংহের গৌরীপুর সাব-রেজিস্ট্রারের কার্যালয়ে একজন উমেদার সরকারের নির্ধারিত ফি’র অতিরিক্ত অর্থ দাবি করার সময় হাতেনাতে ধরা পড়েন। তার বিরুদ্ধে ব্যবস্থা গ্রহণের নির্দেশ প্রদান করা হয়।
চট্টগ্রাম জেলা রেজিস্ট্রারের কার্যালয়ে সাবেক এক অফিস সহকারীকে অনুমোদন ব্যতিরেকে বরখাস্তের আদেশ প্রত্যাখ্যান এবং ১৯ জন নকলনবিশ নিয়োগে অনিয়মের প্রাথমিক প্রমাণ পাওয়া যায়। এ বিষয়ে সংশ্লিষ্ট জেলা রেজিস্ট্রারকে কারণ দর্শানোর নোটিশ দেওয়া হয়। এছাড়া এক পদোন্নতিতে সিনিয়রদের উপেক্ষা ও দূরবর্তী কর্মকর্তা দ্বারা অতিরিক্ত দায়িত্ব প্রদানের পরিপ্রেক্ষিতে রেকর্ডপত্র চাওয়া হয়েছে।
ঠাকুরগাঁওয়ের লাহিড়ী সাব-রেজিস্ট্রারের কার্যালয়ে বায়না ও কবলা দলিল সম্পাদনে অনিয়ম এবং নকল পেতে অতিরিক্ত ফি আদায়ের অভিযোগের সত্যতা পাওয়া যায়।
বরিশাল সদর সাব-রেজিস্ট্রারের কার্যালয়ে চর বদনা মৌজায় নিষেধাজ্ঞা থাকা সত্ত্বেও দলিল সম্পাদন এবং উৎসে কর জমা না দিয়েই দলিল সম্পাদনের তথ্য পাওয়া যায়, যা পরবর্তীতে প্রমাণ ছাড়াই সমন্বয় করা হয়েছে বলে দাবি করা হয়।
টাঙ্গাইলের কালিহাতী সাব-রেজিস্ট্রারের কার্যালয়ে সাবেক সাব-রেজিস্ট্রারের বিরুদ্ধে অসাধু উদ্দেশ্যে হয়রানি ও সামান্য তথ্যগত অমিল দেখিয়ে অতিরিক্ত অর্থ আদায়ের অভিযোগ পাওয়া যায়।
শরীয়তপুর সদর সাব-রেজিস্ট্রারের কার্যালয়ে শ্রেণি পরিবর্তনের মাধ্যমে দলিল রেজিস্ট্রেশন করে ৩৮ লাখ ৮৩ হাজার ৫০৫ টাকা রাজস্ব ক্ষতির তথ্য প্রমাণসহ উদঘাটিত হয়।
এ ছাড়া বাগেরহাটের মোড়েলগঞ্জ উপজেলা সাব-রেজিস্ট্রারের কার্যালয়, বগুড়া জেলার কাহালু উপজেলা সাব-রেজিস্ট্রার, কক্সবাজার জেলার উখিয়া উপজেলা সাব-রেজিস্ট্রার অফিস, চট্টগ্রাম জেলার চন্দনাইশ উপজেলা সাব-রেজিস্ট্রার অফিস, কুমিল্লা জেলার লাঙ্গলকোট উপজেলা সাব-রেজিস্ট্রার অফিস, ঢাকার আশুলিয়া ও মিরপুর সাব-রেজিস্ট্রার অফিস, ফরিদপুর জেলার চরভদ্রাসন উপজেলা সাব-রেজিস্ট্রার অফিস, গাজীপুর জেলার সদর উপজেলা সাব-রেজিস্ট্রার অফিস, হবিগঞ্জ জেলার চুনারুঘাট উপজেলা সাব-রেজিস্ট্রার অফিস, ঝিনাইদহ সদর উপজেলা সাব-রেজিস্ট্রার অফিস, খুলনা জেলা রেজিস্ট্রারের অফিস, কিশোরগঞ্জ জেলার ইটনা উপজেলা সাব-রেজিস্ট্রার অফিস, কুড়িগ্রাম জেলার সাব-রেজিস্ট্রার অফিস, নারায়ণগঞ্জ সদর উপজেলা সাব-রেজিস্ট্রার অফিস, নোয়াখালী সদর উপজেলা সাব-রেজিস্ট্রার অফিস, নওগাঁ সদর উপজেলা সাব-রেজিস্ট্রার অফিস, পাবনা সদর উপজেলা সাব-রেজিস্ট্রার অফিস, পটুয়াখালী জেলার বাউফল, ঝালকাঠি জেলার রাজাপুর, রাজশাহী জেলার গোদাগাড়ী ও রংপুর জেলা সাব-রেজিস্ট্রার অফিস এবং জামালপুরের সরিষাবাড়ী সাব-রেজিস্ট্রার অফিসে অভিযান পরিচালনা করে সরকার নির্ধারিত ফি’র অতিরিক্ত অর্থ আদায়, হয়রানি, দালাল চক্রের সক্রিয়তা এবং রেকর্ডপত্রে অসঙ্গতির প্রাথমিক সত্যতা পাওয়া যায়।