ভারতের জম্মু ও কাশ্মীরে সন্ত্রাসী হামলার ঘটনায় পাকিস্তানের সঙ্গে সম্পর্ক নিয়ে উত্তেজনা দেখা দিয়েছে। এ হামলার পর উভয় দেশ একে অপরের বিরুদ্ধে পাল্টাপাল্টি পদক্ষেপ ঘোষণা করেছে, যা বৃহত্তর সংঘাতের আশঙ্কা বাড়িয়েছে।
ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির নেতৃত্বে এক মন্ত্রিসভার বৈঠকের পর ভারত ৬০ বছরের পুরোনো সিন্ধু পানি চুক্তি (আইডব্লিউটি) স্থগিতের ঘোষণা দেওয়া হয়েছে। এ চুক্তির মাধ্যমে উভয় দেশের জন্য গুরুত্বপূর্ণ সিন্ধু নদী ব্যবস্থার ব্যবহার নিয়ন্ত্রণ করে। এ ছাড়াও ভারত পাকিস্তানের সঙ্গে সীমান্ত বন্ধ, বাণিজ্য স্থগিত, ভিসা বাতিল এবং ভারতে পাকিস্তানি কূটনীতিকদের সংখ্যা হ্রাসের ঘোষণা দেয়।
জবাবে, পাকিস্তানের শীর্ষ বেসামরিক-সামরিক সিদ্ধান্ত গ্রহণকারী সংস্থা জাতীয় নিরাপত্তা কমিটি (এনএসসি) অনুরূপ পদক্ষেপ ঘোষণা করে। এর মধ্যে রয়েছে সীমান্ত ও আকাশসীমা বন্ধ, বাণিজ্য স্থগিত এবং সবচেয়ে উল্লেখযোগ্যভাবে, ভারতের সঙ্গে সব দ্বিপাক্ষিক চুক্তি, বিশেষ করে শিমলা চুক্তি, স্থগিত করার হুমকি।
১৯৭২ সালে স্বাক্ষরিত শিমলা চুক্তি ভারত-পাকিস্তান সম্পর্কের ভিত্তি হিসেবে কাজ করে। এটি লাইন অব কন্ট্রোল (এলওসি) নিয়ন্ত্রণ করে এবং শান্তিপূর্ণভাবে বিরোধ নিষ্পত্তির প্রতিশ্রুতি দেয়। পাকিস্তানের এই চুক্তি স্থগিত করার হুমকি একটি গুরুতর উত্তেজনা বৃদ্ধির ইঙ্গিত দেয়।
শিমলা চুক্তি কী?
১৯৭১ সালের ভারত-পাকিস্তান যুদ্ধ-পরবর্তী সময়ে দুই দেশের মধ্যে শিমলা চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়। এই চুক্তিটি দুই দেশের ভবিষ্যৎ সম্পর্কের ভিত্তি গড়ে দেয় এবং কাশ্মীর ইস্যুসহ সমস্ত দ্বিপাক্ষিক সমস্যা শান্তিপূর্ণ উপায়ে আলোচনা ও সমঝোতার মাধ্যমে সমাধানের কথা বলা হয়েছিল।
১৯৭২ সালের ২ জুলাই ভারতের হিমাচল প্রদেশের শিমলায় ভারতের পক্ষে তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধী ও পাকিস্তানের পক্ষে তৎকালীন প্রেসিডেন্ট জুলফিকার আলি ভুট্টো এ চুক্তি স্বাক্ষর করেন। চুক্তির মূল বিষয়গুলোর মধ্যে ছিল শান্তিপূর্ণভাবে বিরোধ নিষ্পত্তি এবং কাশ্মীরসহ বিষয়গুলো দ্বিপাক্ষিকভাবে সমাধানের প্রতিশ্রুতি। এটি অঞ্চলের সার্বভৌমত্ব, অখণ্ডতা, রাজনৈতিক স্বাধীনতা এবং অভ্যন্তরীণ বিষয়ে হস্তক্ষেপ না করার প্রতিশ্রুতিও বহন করে।
চুক্তিতে সমস্ত দ্বিপাক্ষিক বিরোধ শান্তিপূর্ণভাবে সমাধানের প্রতিশ্রুতি দেওয়া হয়। এতে বলা হয়, ভারত ও পাকিস্তান একমত হয় যে তারা সব ধরনের বিরোধ শান্তিপূর্ণভাবে এবং দ্বিপাক্ষিক আলোচনার মাধ্যমে সমাধান করবে। কোনো আন্তর্জাতিক মধ্যস্থতার প্রতি নির্ভর না করে, দুই দেশ নিজেদের মধ্যে আলোচনা করেই সমস্যা মেটাবে।
চুক্তির মাধ্যমে কাশ্মীর অঞ্চলে ভারত ও পাকিস্তানের মধ্যে নতুনভাবে একটি ‘লাইন অফ কন্ট্রোল’ নির্ধারণ করা হয়। এটি যুদ্ধ শেষে অস্ত্রবিরতির রেখা হিসেবে পরিচিত। এছাড়া এ চুক্তির মাধ্যমে ১৯৭১ সালের যুদ্ধে বন্দি হওয়া প্রায় ৯০ হাজার পাকিস্তানি সৈন্যকে মুক্তি দেওয়ার প্রতিশ্রুতি দেয় ভারত।
পাকিস্তানের হুমকি কেন গুরুত্বপূর্ণ?
পাকিস্তানের শীর্ষস্থানীয় আন্তর্জাতিক আইন বিশেষজ্ঞ আহমার বিলাল সুফি শিমলা চুক্তিকে দুই দেশের মধ্যে একটি অন্তর্বর্তী কিন্তু গুরুত্বপূর্ণ কাঠামো হিসেবে বর্ণনা করেছেন। তিনি বলেন, এই চুক্তি স্থগিত করার জন্য পাকিস্তানকে দেশের স্বার্থ রক্ষার জন্য অত্যন্ত সতর্কতার সঙ্গে অভ্যন্তরীণ মূল্যায়ন করতে হবে।
আন্তর্জাতিক আইনের আরেক বিশেষজ্ঞ মুহাম্মদ মুশতাক আহমদ বলেন, ভারত দীর্ঘদিন ধরে শিমলা চুক্তিকে জাতিসংঘের নিরাপত্তা পরিষদের (ইউএনএসসি) রেজুলেশনের উপরে স্থান দিয়ে এটিকে কাশ্মীর ইস্যুকে সম্পূর্ণ দ্বিপাক্ষিক বিষয় হিসেবে ব্যাখ্যা করে।
কাশ্মীর ১৯৪৭ সালে ব্রিটিশ শাসন থেকে স্বাধীনতার পর থেকে দুই দেশের মধ্যে উত্তেজনার কেন্দ্রবিন্দু। পারমাণবিক শক্তিধর এই প্রতিবেশী দেশগুলো চারটি যুদ্ধে লিপ্ত হয়েছে, যার তিনটি কাশ্মীর নিয়ে।
পাকিস্তানের অবস্থান হলো, শিমলা চুক্তি কাশ্মীরের জন্য কূটনৈতিক ও রাজনৈতিক সমাধানের পক্ষে ইউএনএসসি রেজুলেশনের পুনর্ব্যক্তি করে। ২০১৯ সালে মোদি সরকার ভারত-শাসিত কাশ্মীরের আধা-স্বায়ত্তশাসিত মর্যাদা বাতিল করার পর পাকিস্তান নয়াদিল্লিকে শিমলা চুক্তি লঙ্ঘনের অভিযোগ করে।
ভারতীয় প্রতিরক্ষা বিশ্লেষক অজয় শুক্লা বলেন, যদি এক বা উভয় দেশ শিমলা চুক্তি থেকে বেরিয়ে যায়, তবে এলওসিতে এটি একটি ‘উন্মুক্ত পরিস্থিতি’ সৃষ্টি করবে, যা উভয় পক্ষকে অস্ত্র ব্যবহারের প্রণোদনা দিতে পারে।
শিমলা চুক্তি স্থগিত করা কি যুদ্ধের ঘোষণা?
শিমলা চুক্তি থাকা সত্ত্বেও, ভারত ও পাকিস্তান সিয়াচেন গ্লেসিয়ার নিয়ন্ত্রণের জন্য চার দশকের সংঘর্ষ এবং ১৯৯৯ সালের কার্গিল যুদ্ধে জড়িয়েছে।
আহমদ বলেন, এলওসি কখনোই স্থায়ী শান্তি প্রতিষ্ঠা করতে পারেনি। পাকিস্তানি সাংবিধানিক বিশেষজ্ঞ রিদা হোসেন বলেন, ভারত ঐতিহাসিকভাবে শিমলা চুক্তিকে নিজের সুবিধার জন্য ‘অপব্যবহার’ করেছে।
শুক্লা বলেন, পাকিস্তানের চুক্তি থেকে বেরিয়ে যাওয়া স্বয়ংক্রিয়ভাবে যুদ্ধের ঘোষণা না হলেও, এটি দুই প্রতিবেশীকে সামরিক সংঘাতের কাছাকাছি নিয়ে যাবে।
পাকিস্তানের যুক্তি কী?
পাকিস্তান এখনো চুক্তি থেকে সরেনি, কেবল হুমকি দিয়েছে। বিশ্লেষকরা বলছেন, এটি ভারতের প্রতি একটি কূটনৈতিক চাপ প্রয়োগের কৌশল। পাকিস্তান চায় কাশ্মীর ইস্যুকে আবারও আন্তর্জাতিক পর্যায়ে তুলতে, যেখানে জাতিসংঘের প্রস্তাব বিবেচনায় আসবে।
শুক্লা বলেন, চুক্তি স্থগিত করা উভয় পক্ষকে এলওসিতে তাদের স্বার্থ অনুসরণের জন্য আন্তর্জাতিক কভার প্রদান করতে পারে। আহমদ বলেন, ভারতের আইডব্লিউটি স্থগিত করা ইতিমধ্যেই আন্তর্জাতিক আইনে আগ্রাসন হিসেবে বিবেচিত হতে পারে, যা পাকিস্তানের আত্মরক্ষামূলক পদক্ষেপকে ন্যায্যতা দিতে পারে।
আহমদের মতে, শিমলা চুক্তি থেকে বেরিয়ে যাওয়ার হুমকি ভারতকে সতর্ক করার জন্য পাকিস্তান সরকারের একটি ‘স্মার্ট সিদ্ধান্ত’।