বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামীর আমির ডা. শফিকুর রহমান বলেছেন, শহীদরা তো মহাসৌভাগ্যবান। তারা চলে গেলেন। মায়েরা তাদের ফিরিয়ে আনার কথা বলবেন না। তারা জান্নাতের পথের অগ্রসৈনিক। বিভিন্ন হাসপাতালে বাড়িতে আহত ভাইবোনদের দেখতে গেছি। কলিজা ফেটে গেছে। তখন দেখেছি যুবক ছেলে দুই চোখে গুলি লেগে অন্ধ হয়ে গেছে। আহ্! সে তো আর জীবনে আলো দেখবে না। আলো নিভে গেছে তার। যতদিন বেঁচে আছে কারও সাহায্য ছাড়া একটা কদমও ফেলতে পারবে না। এদের মা-বাবাকে আমরা কী সান্ত্বনা দেব।
বৃহস্পতিবার (২৯ আগস্ট) নারায়ণগঞ্জের সিদ্ধিরগঞ্জে বৈষম্যবিরোধী আন্দোলনে শহীদ পরিবারের সদস্যদের সঙ্গে মতবিনিময় সভায় অংশ নিয়ে একথা বলেন তিনি।
তিনি আরও বলেন, এদের আপনজনকে আমরা কী সান্ত্বনা দেব। সেদিন এই নারায়ণগঞ্জে এসেছিলাম। আমাদের শহীদ বোন সুমাইয়া। তার আড়াই মাসের নিষ্পাপ শিশুর দিকে তাকিয়ে আমরা নিজেদের ধরে রাখতে পারিনি। ও কাকে মা বলে ডাক দেবে। একটা বাচ্চার সবচেয়ে বেশি সম্পর্ক তার মায়ের সঙ্গে। সে তার মায়ের নাড়ি ছেড়া ধন। যখন সে দেখবে অন্য বাচ্চারা মা মা বলে ডাকছে তখন সে মা বলার জন্য কাউকে খুঁজে পাবে না। ওদেরকে আমরা কী সান্ত্বনা দেব।
তিনি আরও বলেন, এই শোকগুলো একত্র করে আমরা শক্তিতে রূপান্তর করব। আমরা অঙ্গীকার নেব যে আমরা শহীদদের মর্যাদা রাখবো। তার সঙ্গে বিশ্বাসঘাতকতা করব না। জামায়াত ইসলামী একটি ইসলামী রাজনৈতিক দল। আমরা চাই সৎ নেতৃত্ব বসুক। দেশপ্রেমিক নেতৃত্ব বসুক। যারা গদিকে নিজেদের বাপ-দাদার সম্পদ মনে করবে না। আর জনগণকে নিজেদের দাস বানাবার চিন্তা করবে না। বরং জনগণের চৌকিদার হিসেবে নিজেদের মনে করবে জনগণ ঘুমাবে শান্তিতে আর উনারা রাত জেগে পাহারা দেবে জনগণকে।
তিনি আরও বলেন, আসলে আমাদের ইতিহাস বড়ই বিচিত্র। ইতিহাসের পালা বদলে আমরা বন্ধুকে শত্রু বানাই, শত্রুকে বন্ধু বানাই। এরকম যে জাতি করে সে জাতি কোনো দিন বিশ্বের দরবারে ও নিজের বিবেকের কাছে সম্মানিত হতে পারে না। অপসংস্কৃতির এই যন্ত্রণা থেকে এই জাতিকে বের হয়ে আসতে হবে। যার যেখানে যে অবদান জাতির জন্য এটা শ্রদ্ধার সঙ্গে স্বীকার করতে হবে।
তিনি বলেন, আমরা আজকে শহীদ পরিবারের কাছে এসেছি সান্ত্বনা দেওয়ার জন্য নয় বরং আমরা এসেছি অনুপ্রেরণা নেওয়ার জন্য। তারা বড়ই সৌভাগ্যবান শুধু শহীদদের হাশরের দিনে আল্লাহ জিজ্ঞেস করবেন, তুমি তোমার জীবনের সর্বোচ্চ সম্পদ আমার জন্য দান করেছ। আজকে আমি আমার জান্নাতের সব দুয়ার তোমার জন্য খুলে দিলাম।
তিনি আরও বলেন, আমার আফসোস এবারের এই যুদ্ধে আমি শহীদের পরিবারের একজন হতে পারলাম না। এ সৌভাগ্য যাদের আল্লাহ দান করেছেন তাদের আমার ঈর্ষা হয়। আমি যদি তাদের একজন হতাম। আমরা আজকে ঘোষণা করতে এসেছি আমরা আপনার পরিবারের সদস্য হতে চাই।
আমিরে জামায়াত বলেন, এই আন্দোলন সংগ্রামে জাতি, ধর্ম ও দলের মধ্যে কোনো ব্যবধান ছিল না। এখানে অন্য ধর্মের অনেক লোকও নির্মমভাবে মারা গেছেন। আমরা এদের সবাইকে গভীর শ্রদ্ধার সঙ্গে স্মরণ করব। জাতি হিসেবে আমরা ঋণী। আজীবন যেন এ জাতি এই ঋণের অনুমতি নিয়ে চলে এবং ঋণ আদায়ের চেষ্টা করে আল্লাহর কাছে। আমি এই সরকার সম্পর্কে কিছুই বলবো না। তাদের বিষয়টা আল্লাহর হাতে সোপর্দ করে দিলাম। রক্তের এক একটা ফোয়ারা মিলিত হয়ে রক্তের প্লাবন সৃষ্টি হয়েছে। বাংলাদেশের এমন কোনো জনপদ নাই যেটা রক্তাক্ত হয়নি।
তিনি আরও বলেন, যারা ক্ষমতার জন্য এত বেপরোয়া হয়ে গেল তারা কী একটা বারও চিন্তা করল না যে এরাও মানুষ। এরা এদেশের নাগরিক। কত বাচ্চাকে তারা এতিম করে দিয়েছে। কত মেয়েকে বিধবা বানিয়ে ফেলেছে। কত বাবাদের বুক ভেঙে দিয়েছে। একটাবারও কী তারা চিন্তা করল না। রাজশাহীতে গিয়েছিলাম। একটা ভাই রিকশা চালিয়ে কোনো রকমে জীবন চালায়। ওই সময় সেই যুবক নিজেকে ধরে রাখতে পারেনি। রিকশা গ্যারেজে ফেলে এক কলসি পানি নিয়ে, একটা গ্লাস হাতে নিয়ে দৌড়ে গেছে। যারা এই কঠিন রোদের মধ্যে কষ্ট করছে তাদের হাতে একটু পানি তুলে দেবে। পানি খাওয়া শেষ। কলসি একদিকে রেখে সেও নেমে গেছে ওদের সাহায্য করতে। জালিমের তিনটা বুলেট এপার ওপার করে তাকে দুনিয়া থেকে বিদায় করে দিয়েছে। তার বিয়ে হয়েছে এক বছর হলো তার স্ত্রী পাঁচ মাসের অন্তঃসত্ত্বা। আমি চিন্তা করলাম এই মেয়েটা যদি আমার ঔরসজাত মেয়ে হত তাহলে আমার অনুভূতি কী হতো।
আমি মেয়েটাকে জিজ্ঞেস করলাম, মারে তোমার অনুভূতি কী, তুমি কেমন আছো? আমাকে বলল- বাবা আমি যেমন থাকি, আমি আমার গর্ভের সন্তান নিয়ে চিন্তিত। ওর কী হবে? সে তো একজন গরীব রিকশাওয়ালার সন্তান, আমার পেটে রেখে দিছি। আমি কী পারব তাকে মানুষ করতে। এই মেয়েটাকে বললাম, আজকে থেকে তুমি আমার মেয়ে। তোমার যাবতীয় দায়িত্ব বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামী কবুল করলো। তোমাদের বেঁচে থাকা, বেড়ে ওঠা আল্লাহই রহমত দেবে। মানুষ হিসেবে আমরা তোমার পাশে থাকবো। এখন থেকে প্রতি মাসে তোমাদের চলার মতো একটা অংশ তোমাদের কাছে পৌঁছে যাবে ইনশাআল্লাহ। তোমার এই বেবি দোয়া করি দুনিয়ায় আসুক। মেয়ে হোক ছেলে হোক আল্লাহ যা পছন্দ করেছে তোমার জন্য যেন চক্ষু শীতলকারী হয়। ও বড় হওয়া পর্যন্ত লেখাপড়াসহ যা কিছু প্রয়োজন ইনশাআল্লাহ আমরা দায়িত্ব নিলাম।
তিনি আরও বলেন, যেখানে যাই নিজেকে ধরে রাখতে পারি না। আমাদের এতো টাকা পয়সা নাই কিন্তু আল্লাহর ভান্ডারে কোনো কমতি নাই। আমরা তার ওপর ভরসা করে এ কথাগুলো বলেছি। আল্লাহ যেন আমাদের ওয়াদার জায়গা ঠিক রাখেন। অনেক শহীদ পরিবারের সঙ্গে আমাদের মোলাকাত হয়েছে। তারা বলছেন, আমাদের কোনো আর্থিক সহায়তা লাগবে না। আপনারা এসেছেন আমরা প্রশান্তি পেয়েছি। এই জাতি যেন আমার সন্তানকে ভুলে না যায়।
তিনি আরও বলেন, আমরা প্রধান উপদেষ্টার সঙ্গে বসেছিলাম। আমরা বলেছি, পরিবারগুলো আর্থিক সহায়তার প্রয়োজন তাদের জন্য অর্থবহ সহায়তা দেওয়ার। পদক্ষেপ আপনারা নেবেন। রাষ্ট্রের সব খাতের সঙ্গে এটাকে আপনারা সর্বাধিক অগ্রাধিকার দেবেন। আহতদের চিকিৎসা সর্বোচ্চ যেটা সম্ভব দেওয়ার চেষ্টা করুন। আমরা আপনার পাশে আছি। তারা কথা দিয়েছে এটা করবেন।
তিনি আরও বলেন, শহীদের রক্ত শুকিয়ে গেছে। সেটা যেন আমাদের অন্তর থেকে চলে না যায়। এখনও অনেক লোক নিখোঁজ আছে। কোথায় তাদের লাশ আপনজন কেউ জানে না। আসলেই কি তারা জীবিত নাকি লাশ হয়ে দুনিয়া থেকে বিদায় নিয়েছে কেউ জানে না। সেই রাতগুলোতে অনেক অপকর্ম হয়েছে। যেমনটি হয়েছিল ২০১৩ সালের শাপলা চত্বরে। সারাদেশ থেকে আসা ওলামায়ে কেরামদের সঙ্গে যে নিষ্ঠুর আচরণ করা হয়েছে। সেই রাতের লাশগুলো কোথায় গিয়েছে কেউ জানে না।
তিনি বলেন, আমরা চেষ্টা করছি সারা দেশে যারা এরকম নিহত হয়েছেন তাদের তথ্য সংগ্রহ করতে। আমাদের তথ্য সংগ্রহকারীরা হিমশিম খাচ্ছে। অনেক জায়গায় গিয়ে তারা মায়েদের বুকফাটা কান্না সহ্য করতে পারছে না। তারা বলে বাবা আমার ছেলেটা কোথায় আছে একটু বলতে পারবা? এই মায়ের কাছে এই জাতী কী জবাব দেবে।
এসময় উপস্থিত ছিলেন- ছাত্রশিবির কেন্দ্রীয় কমিটির সাধারণ সম্পাদক জাহিদুল ইসলাম, জামায়াতের কেন্দ্রীয় নির্বাহী পরিষদ সদস্য সাইফুল ইললাম খান মিলন, জামায়াতের কর্মপরিষদ সদস্য মাওলানা মঈনউদ্দিন আহমদ, জামায়াতের নারায়ণগঞ্জ মহানগরের নায়েবে আমির মাওলানা আব্দুল কাইউম, সাধারণ সম্পাদক ইঞ্জিনিয়ার মনোয়ার হোসেন, জেলা জামায়াতের সহকারী সাধারণ সম্পাদক জামাল হোসেনসহ অন্যরা।