স্বাধীন দুর্নীতি দমন কমিশন গড়ে তুলতে দুদকের নিয়োগ প্রক্রিয়াকে দলীয় প্রভাবমুক্ত করার আহ্বান জানিয়েছেন ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশের (টিআইবি) নির্বাহী পরিচালক ড. ইফতেখারুজ্জামান।
তিনি বলেছেন, কমিশনের কর্মকর্তাদের আমলাতান্ত্রিক আনুগত্য নির্মুল করতে হবে। রাজনৈতিক ও আমলাতান্ত্রিক প্রভাবমুক্ত করতে না পারলে সংস্কার ব্যর্থ হবে।
বাংলাদেশে যত দিন পর্যন্ত সরকারি-বেসরকারি সংস্থা ও দপ্তরগুলোতে রাজনৈতিক- আমলাতান্ত্রিক প্রভাবমুক্ত সংস্কৃতি তৈরি না হবে, তত দিন দুদক বা অন্য দুর্নীতি বিরোধী প্রতিষ্ঠানগুলোর কার্যক্রমের সফলতা আসবে না।
আন্তর্জাতিক দুর্নীতিবিরোধী দিবস উপলক্ষে রোববার ঢাকার মানিক মিয়া এভিনিউয়ে জাতীয় সংসদ ভবনের সামনে টিআইবি আয়োজিত মানববন্ধনে তিনি এসব কথা বলেন।
ইফতেখারুজ্জামান বলেন, আমরা প্রথম থেকে বলে আসছি, এমন একটি দুর্নীতি দমন কমিশন চাই যেখানে নেতৃত্ব থেকে শুরু করে সব পর্যায়ে কোনো প্রকার দলীয় রাজনৈতিক প্রভাব থাকবে না। বিশেষ করে কমিশন নিয়োগের ক্ষেত্রে কোনো প্রকার দলীয় প্রভাবে যেন নিয়োগ দেওয়া না হয়, সেটি নিশ্চিত করতে হবে। সচিব ও মহাপরিচালক যারা আছেন তাদের মধ্যে যে আমলাতান্ত্রিক আনুগত্য সেটি নির্মূল করতে হবে।
দলীয়করণ, আমলাতন্ত্র, অভ্যন্তরীণ দুর্নীতি, অনিয়ম, অনাচারের কারণে দুদক দুর্বল প্রতিষ্ঠানে পরিণত হয়েছে বলে দাবি করেছেন তিনি। আর এ কারণে সাঁড়াশি বা শুদ্ধি অভিযানের মাধ্যমে দুদককে ঢেলে সাজানোর পরামর্শ দিয়ে ইফতেখারুজ্জামান বলেন, এমন কমিশন প্রতিষ্ঠা করতে হবে, যা দলীয় রাজনৈতিক প্রভাবমুক্ত থাকবে, বিশেষ করে কমিশনার নিয়োগে। এ ছাড়া দুদকের সচিব ও মহাপরিচালক পদে যারা আসবেন, তাদের মধ্যে আমলাতান্ত্রিকতার প্রতি আনুগত্যের মনোভাব দূর করতে হবে। এ দুটি নিশ্চিত করতে হবে। এটা করার এখতিয়ার এ সরকারের আছে।
জবাবদিহিতামূলক শাসন কাঠামো গড়ে তোলার প্রত্যাশা রেখে নির্বাহী পরিচালক বলেন, সরকার যে কাজ করছে, তাতে ওয়াচ ডগের ভূমিকা পালন করছে তরুণ প্রজন্ম। বৈষম্যবিরোধী আন্দোলন যে চেতনা থেকে হয়েছে, তাতে তরুণ প্রজন্ম দেখিয়েছে, দুর্নীতির বিরুদ্ধে তারা রক্ত দিতেও পারে।
বর্তমান সরকারের রাজনৈতিক কোনো উচ্চাকাঙ্ক্ষা নেই জানিয়ে তিনি বলেন, দুদকের পাশাপাশি রাষ্ট্র কাঠামো এমনভাবে সংস্কার করতে হবে, যাতে ভবিষ্যতে যারা ক্ষমতায় আসবে নির্বাচনের মাধ্যমে; তাদের কাছে যেন একটা অবকাঠামো তৈরি হয়, দুর্নীতিবিরোধী অবস্থান অব্যাহত রাখার জন্য।
মূল প্রবন্ধে টিআইবির উপ সমন্বয়ক জাফর সাদিক বলেন, প্রতি বছর গড়ে বাংলাদেশ থেকে ১০-১২ বিলিয়ন ডলার পাচার হয়। বিগত কর্তৃত্ববাদী সরকারের আমলে বিভিন্ন প্রকল্প থেকে অর্থ লুটপাটের জন্য প্রকল্প পাসের আগে কৃত্রিমভাবে খরচ বৃদ্ধি, বাড়তি অর্থ নানাভাবে সরিয়ে নেওয়া, কেনাকাটার ক্ষেত্রে প্রতিযোগিতাহীন দরপত্র ও পছন্দের লোককে কাজ দেওয়ার ঘটনা অহরহ ঘটেছে।
প্রকল্পেও অনিয়মের প্রসঙ্গে জাফর সাদিক বলেন, বিভিন্ন প্রকল্পে নিয়োগের ক্ষেত্রেও ব্যাপকভাবে স্বজনপ্রীতি, বিশেষ করে প্রকল্প পরিচালক নিয়োগের ক্ষেত্রে রাজনৈতিক সম্পৃক্ততা বেশি প্রাধান্য দেওয়া, ঠিকাদার নিয়োগের ক্ষেত্রেও রাজনৈতিক বিবেচনাকে প্রাধান্য দিয়ে অতিমূল্যায়িত চুক্তি, ঘুষ গ্রহণ একটি নিয়মিত চর্চায় পরিণত হয়েছিল পতিত সরকারের শাসনামলে। মূলত সে সময়ে দুর্নীতির মহোৎসবের পাশাপাশি বিচারহীনতাকে স্বাভাবিকতায় পরিণত করা হয়েছিল।
এ সময় দুর্নীতি প্রতিরোধে ১৪ দফা দাবি জানায় টিআইবি। দাবিগুলোর মধ্যে রয়েছে—বিচার বিভাগের নিয়োগ, পদায়ন, বদলিসহ বিচারিক প্রক্রিয়ায় রাজনৈতিক হস্তক্ষেপ বন্ধ করতে অবিলম্বে বিচার বিভাগের জন্য পৃথক সচিবালয় গঠন করা; দেশের আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির দ্রুত উন্নয়নের পাশাপাশি একটি জনবান্ধব পুলিশ বাহিনী তৈরিতে এর ব্যবস্থাপনা কর্মকাঠামো পুরোপুরি ঢেলে সাজানোর ব্যবস্থা করা; দুর্নীতির বিরুদ্ধে শূন্য সহনশীলতার ফাঁকা বুলির সংস্কৃতি পরিহার করে, সকল প্রকার-বিশেষ করে উচ্চ পর্যায়ের দুর্নীতির বিচারহীনতা বন্ধে কার্যকর উদ্যোগ গ্রহণ ইত্যাদি।
এদিকে ৯ ডিসেম্বর আন্তর্জাতিক দুর্নীতিবিরোধী দিবস পালনে স্থানীয় ও জাতীয় পর্যায়ে নানা কর্মসূচি হাতে নিয়েছে টিআইবি। ‘নতুন বাংলাদেশ-দুর্জয় তারুণ্য দুর্নীতি রুখবেই’ এই প্রতিপাদ্যে দিবসটি দেশে উদযাপন করা হচ্ছে।
স্থানীয় পর্যায়ে ৪৫টি জেলা ও উপজেলায় টিআইবির অনুপ্রেরণায় গঠিত সচেতন নাগরিক কমিটি (সনাক), অ্যাকটিভ সিটিজেনস গ্রুপ (এসিজি), ইয়ুথ এনগেজমেন্ট অ্যান্ড সাপোর্ট (ইয়েস) গ্রুপের সদস্যদের সক্রিয় অংশগ্রহণে দুর্নীতিবিরোধী ক্যাম্পেইন, প্রশাসনের সঙ্গে যৌথভাবে র্যালি, মানববন্ধন ও আলোচনা অনুষ্ঠান, দুর্নীতিবিরোধী বিতর্ক, কুইজ ও ওরিয়েন্টেশন, জনসমাবেশ ও পথসভা, কার্টুন প্রদর্শনী ও লিফলেট বিতরণসহ নানা কার্যক্রম হাতে নিয়েছে।
এ ছাড়াও, দুর্নীতিবিরোধী কার্টুন প্রতিযোগিতা ও প্রদর্শনীর আয়োজন করা হয়েছে। দেশের বিভিন্ন স্কুল-কলেজ ও বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা দুইটি বয়সভিত্তিক বিভাগ, ডিজিটাল কার্টুন ও কমিক স্ট্রিপ বিভাগে এই প্রতিযোগিতায় অংশ নিয়েছে। টিআইবির প্রধান কার্যালয়ে প্রতিযোগিতার সেরা ৬০টি কার্টুন নিয়ে সোমবার থেকে প্রদর্শনী শুরু হচ্ছে, যা চলবে সপ্তাহব্যাপী।