মারা যাওয়ার খানিক আগে তার ফেসবুক পোস্টে লেখা হয়, ‘আমি জানি এটা কোনো সলিউশন না, কিন্তু আমাকে বাঁচতে দিতেসে না, বিশ্বাস করুন। আমি বাঁচতে চাইছিলাম… এটা সুইসাইড না মার্ডার। টেকনিক্যালি মার্ডার।’ এরপরই ফাইরুজ সাদাফ অবন্তিকার (২৪) পৃথিবী থেকে প্রতিবাদী চলে যাওয়া।
গত বছর ১৫ মার্চ রাত সাড়ে ৯টা থেকে ১০টার মধ্যের ঘটনা। কুমিল্লা শহরের বাগিচাগাঁও ভাড়া ফ্ল্যাট থেকে ঝুলন্ত অবস্থায় অবন্তিকাকে উদ্ধার করে কুমিল্লা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে নিলে চিকিৎসক মৃত ঘোষণা করেন।
অবন্তিকা আগের দিনই জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয় থেকে কুমিল্লার বাসায় মায়ের কাছে ফেরেন। মেয়ের এমন মর্মান্তিক মৃত্যুর এক বছর হলেও মামলার চার্জশিট না হওয়ায় ক্ষোভ প্রকাশ করেন মা স্কুল শিক্ষিকা তাহমিনা বেগম।
অবন্তিকা জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ে আইন বিষয়ে মাস্টার্স পড়ছিলেন। একই বিষয়ে সেখান থেকেই অনার্স চূড়ান্ত পরীক্ষা শেষ করেন অবন্তিকা। মৃত্যুর দুই মাসের মাথায় অনার্সের ফল বের হয়। তাতে তৃতীয় স্থান অর্জন করেন তিনি। ইচ্ছা ছিল বিচারক হওয়ার। তার আত্মহননের খবর ঘটনার রাতেই ছড়িয়ে পড়লে জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয় উত্তাল হয়ে ওঠে। কুমিল্লাসহ সারা দেশ বিক্ষোভে ফেটে পড়ে। পরদিন কুমিল্লা কোতোয়ালি থানায় আত্মহত্যার প্ররোচনার মামলা করেন মা তাহমিনা বেগম। দেশ শান্ত করতে মামলার সঙ্গে সঙ্গে ঢাকায় গ্রেপ্তার করা হয় সহপাঠী রায়হান সিদ্দিক আম্মান ও জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের সহকারী প্রক্টর দ্বীন ইসলামকে। মামলায় তাদের দুজনকেই প্রধান আসামি করা হয়েছে।
তাহমিনা বেগম বলেন, সহপাঠীর প্রেম প্রত্যাখ্যান করায় তার মেয়েকে দেড় বছরের অধিক সময় ধরে নানাভাবে উত্ত্যক্ত করা হয়। উত্ত্যক্তকারী সহপাঠী, শিক্ষক-প্রক্টর সবাই ছাত্রলীগ-আওয়ামী লীগের রাজনীতির সঙ্গে জড়িত থাকায় এবং বিশ্ববিদ্যালয়ে একই গ্রুপের লোক হওয়ায় এতদিন তদন্ত এগোয়নি। ৫ আগস্টের পটপরিবর্তনের পর অভিযুক্তরা গা ঢাকা দেওয়ায় তিনি কিছুটা আশার আলো দেখছেন। যদিও পুলিশি তদন্তে অগ্রগতি পাননি। এ সময়ে কেউ তার সঙ্গে যোগাযোগও করেনি।
তিনি বলেন, মৃত্যুর আগে অবন্তিকা ফেসবুক পোস্টে স্পষ্ট করেই লিখে গেছে ‘আমি যদি কখনো সুইসাইড করি তবে আমার মৃত্যুর জন্য একমাত্র দায়ী থাকবে আমার ক্লাসমেট আম্মান সিদ্দিকী আর তাকে সাপোর্টকারী জগন্নাথের সহকারী প্রক্টর দ্বীন ইসলাম।’
তাহমিনা বেগম বলেন, ঘটনার দেড় মাসের মধ্যে জামিন হয়ে যায় সহকারী প্রক্টর দ্বীনের। আম্মানের জামিন হয় সাড়ে ছয় মাসের মাথায়। জগন্নাথের আরেক আওয়ামীপন্থি শিক্ষক মাসুম বিল্লাহ তদবির করে সহকারী প্রক্টরের দ্রুত জামিন করিয়ে নেন। উত্ত্যক্তকারীরা পলিটিক্যাল বলে মামলার তদন্ত এতদিন এগোয়নি।
তিনি আরও বলেন, কুমিল্লা কোতোয়ালি থানার পরিদর্শক (তদন্ত) শিবেন বিশ্বাস আসামিদের মাত্র এক দিন রিমান্ডে নেন। রিমান্ড-পরবর্তী জানান আসামিরা কিছুই বলেনি। তখনো জগন্নাথের শিক্ষকরা বিশ্ববিদ্যালয়ের গাড়িতে কুমিল্লা আসেন। পুলিশও কারাগারে তাদের সঙ্গে দেখা করে। তারা সবসময়ই তদন্তে প্রভাব বিস্তার করত।
মৃত্যুর আগের অবন্তিকার ফেসবুক পোস্টগুলো মৃত্যুকালীন ঘোষণা হিসেবে নেওয়া হয়েছে কি না—এমন জিজ্ঞাসার জবাবে ওই পুলিশ কর্মকর্তার ভাষ্য ছিল, পোস্টগুলো মৃত্যু-পরবর্তী সময়ের। দেখছি, দেখি কী করা যায়। মৃত্যুর দিনই অবন্তিকার ব্যবহৃত দুটি মোবাইল জব্দ করে আনলেও নিজের কাছেই রেখে দেন ওই কর্মকর্তা। তিনি ফোনগুলো খোলা রাখতেন ও নেট কানেকশনে থাকত।
তাহমিনা বেগমের ধারণা, ওই কর্মকর্তা ফোনে থাকা অনেক আলামত হয়তো নষ্ট করে ফেলেছেন। প্রায় দুমাস ফোনগুলো তিনি ব্যবহার করেছেন। পরে একটি টিভির টকশোতে তিনি এ অভিযোগ তুললে পরদিনই তড়িঘড়ি করে আদালতের অনুমতি নিয়ে জব্দ করা মোবাইলগুলো ফরেনসিক পরীক্ষার জন্য পাঠান ওই কর্মকর্তা।
কোতোয়ালির ওই কর্মকর্তাও আওয়ামী শাসনামলে পদায়ন হয়ে আসা। তার বদলির পর বর্তমান পরিদর্শক (তদন্ত) মিজানুর রহমান মামলা তদন্ত করছেন।
তাহমিনা বেগম বলেন, জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ একটি তদন্ত কমিটি করেছিল। তারা তিন মাসের মাথায় তদন্ত প্রতিবেদন হাতেও পায়। যা আজ পর্যন্ত আমাদের জানায়নি, প্রকাশও করেনি। কয়েকদিন আগে ভিসি রেজাউল করিম ও রেজিস্ট্রারের সঙ্গে যোগাযোগ করলে তাকে জানানো হয় তদন্ত প্রতিবেদনে আম্মানের সম্পৃক্ততা খুঁজে পাওয়ার প্রমাণ মিলেছে।
তিনি বলেন, বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ এটি সিন্ডিকেট সভায় অনুমোদন করে তারপর আমাদের জানাবে, এমন বাহনা দিচ্ছে। এমন হলেও তো অভিযুক্ত আম্মানসহ অন্যদের বহিষ্কার করার সিদ্ধান্ত হবে। এর মধ্যে তারা অনার্স-মাস্টার্স শেষ করে ফেলেছে।
তাহমিনা বেগম জানান, প্রেম প্রত্যাখ্যান করা হলে আম্মান ক্ষিপ্ত হয়। সে ও তার শিক্ষক গ্রুপ নিয়ে অবন্তিকাকে হেয় করতে ফেসবুকে অবন্তিকার একটি নেতিবাচক মন্তব্যকে ঘিরে কোতোয়ালি থানায় জিডি করে। এই জিডি ঘিরেই ক্রমাগত ওই গ্রুপের উত্ত্যক্তের শিকার হতে থাকেন অবন্তিকা। আম্মানের এক বড় ভাই ও আত্মীয় পুলিশ পরিদর্শক রুবেল ওই জিডি করতে তাকে সহায়তা করেন।
ঘটনা অবন্তিকার অনার্স পড়ার সময় ৪ আগস্ট ২০২২ সালের। সেই জিডিকে কেন্দ্র করেই ঘটনা জানাজানি হয়। এ নিয়ে প্রতিনিয়ত উত্ত্যক্তের শিকার হওয়া অবন্তিকা হাফিয়ে ওঠে। এর ওপর অন্য আসামি সহকারী প্রক্টর দ্বীন ইসলামের কাছে লিখিত অভিযোগ করায় আরও হয়রানির স্বীকার হতে হয় অবন্তিকাকে। বিষয়টি অবন্তিকা আইন বিভাগের ওই সময়ের চেয়ারম্যানকেও জানান।
কোথাও সুরাহা পাননি। উল্টো ক্যাম্পাস ও বাইরে ওই গ্রুপ তাকে আরও উত্ত্যক্ত করতে থাকে। অনলাইনেও উত্ত্যক্ত করতে থাকে তারা। অবস্থার অবনতি হলে অবন্তিকার বাবা কুমিল্লা সরকারি কলেজের পদার্থবিদ্যার অধ্যাপক জামাল উদ্দিন বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষের শরণাপন্ন হন।
বাধ্য হয়ে তিনি ওই নেতিবাচক মন্তব্যের পর অবন্তিকার দোষ স্বীকার করে লিখিত জমা দেন। মীমাংসা হয় জিডি তুলে নেওয়া হবে। কিন্তু দুই বছরেও হয়নি। উপরন্তু উত্ত্যক্ত বাড়তে থাকে। যার ফলে সইতে না পেরে অবন্তিকা আত্মহননের পথ বেছে নেন।
এদিকে অবন্তিকার মৃত্যুর ১১ মাস আগে তার বাবা জামাল উদ্দিন মারা যান। সবমিলিয়ে পরিবারটি তখন বিপর্যস্ত। এখন একমাত্র ছেলে উচ্চ মাধ্যমিকে পড়ুয়া জারিফ জাওয়াদ অপূর্বকে নিয়েই তাহমিনা বেগমের বেঁচে থাকা।
কুমিল্লা কোতোয়ালি থানার পরিদর্শক ও মামলার তদন্ত কর্মকর্তা মিজানুর রহমান বলেন, আমি নতুন এসেছি। মামলা তদন্ত চলছে, কবে নাগাদ শেষ হবে বলতে পারছি না।