গত কয়েকটি নির্বাচনে দেখা যাচ্ছে ভারতের পশ্চিমবঙ্গে বিধানসভা নির্বাচনে মূল লড়াইটা হচ্ছে তৃণমূল কংগ্রেসের সঙ্গে বিজেপির। গত বিধানসভা নির্বাচনের পর লোকসভাতেও বামেরা একটি আসনেও জেতেনি। লোকসভায় মালদহে একটি কেন্দ্রে জয়ের ফলে কংগ্রেসের অবস্থা বামেদের তুলনায় ভালো। এই পরিস্থিতিতে প্রতিটি দলই নিজের মতো করে বিধানসভা নির্বাচনের প্রস্তুতির গতি ক্রমশ বাড়িয়েছে। আর সেটা করতে গিয়ে দেখা যাচ্ছে, প্রতিটি দলই একাধিক সমস্যার মুখে আছে।
বর্তমান বিধানসভার মেয়াদ শেষ হবে ৮ মে। ফলে মার্চ-এপ্রিলে পরবর্তী বিধানসভা নির্বাচন হওয়ার কথা। সেদিক থেকে দেখতে গেলে সময় খুব বেশি নেই। এই অবস্থায় একবার দেখে নেয়া যাক কে কোথায় দাঁড়িয়ে?
• তৃণমূলের প্রস্তুতি
গত ২৭ ফেব্রুয়ারি কলকাতার নেতাজি ইন্ডোর স্টেডিয়ামে ভোটপ্রস্তুতি নিয়ে দলের সম্মেলন করেন মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। সেখানে তিনি তিনটি গুরুত্বপূর্ণ কথা বলেছেন। প্রথমত, ভুয়া ভোটার নিয়ে কেন্দ্রীয় নির্বাচন কমিশনের বিরুদ্ধে সোচ্চার হয়েছেন। বারবার তার মুখে শোনা গেছে খেলা হবে স্লোগান। ফলে একদা বাংলাদেশে অত্যন্ত জনপ্রিয় এই স্লোগান এবারও যে পশ্চিমবঙ্গের ক্ষমতাসীন দল আঁকড়ে থাকবে তার একটা ইঙ্গিত মমতা দিয়েছেন। সেই সঙ্গে তিনি জানিয়েছেন, ভোটকুশলী সংস্থা আইপ্যাক আবার দলের নির্বাচনী কৌশল তৈরি করবে।
ভুয়া ভোটার নিয়ে এরপর অনেক হইচই হয়েছে। প্রবীণ সাংবাদিক ও লেখক শুভাশিস মৈত্র বলেন, ভুয়া ভোটের ক্ষেত্রে মমতা যে উদাহরণ দিয়েছেন, তার মধ্যে দুইটি মুসলিম ভোটারদের উদাহরণ।
তার প্রশ্ন, এর মধ্যে থেকে কি হিন্দু ভোটদাতাদের প্রতি একটা বার্তা দিতে চেয়েছেন মমতা? ২০২৬-এর নির্বাচনেও হিন্দু ভোট ধরে রাখা ও তা বাড়িয়ে নিয়ে যাওয়াটা মমতার কাছে একটা বড় চ্যালেঞ্জ। তৃণমূলের হিন্দু ভোটে ধস নামলে মমতার পক্ষে সরকার গঠন করা কঠিন হয়ে যাবে।
কিছুদিন আগে বাঁকুড়া-সহ কয়েকটি জেলায় বিজেপি-র পোস্টার পড়েছিল, হিন্দু হিন্দু ভাই ভাই, ২০২৬-এ বিজেপি-র সরকার চাই। তারপরই বাঁকুড়া, উত্তর দিনাজপুর, মালদহ, পশ্চিম মেদিনীপুরের অনেক জায়গায় তৃণমূলের পোস্টার-প্রচার চলছে। বাঁকুড়ায় যেমন পোস্টার পড়ে, হিন্দু হিন্দু ভাই, কিন্তু বাঙালি পূর্ণমন্ত্রী নাই। হুগলিতে তৃণমূলের মিছিলে স্লোগান ওঠে, হিন্দু-মুসলিম ভাই ভাই, ২০২৬-এ দিদিকে চাই। কোথাও আবার বলা হয়েছে, হিন্দু হিন্দু ভাই ভাই, গ্যাসে কেন ছাড় নাই।
• ঘুরে দাঁড়াতে মরিয়া সিপিএমের আত্মবীক্ষণ
৩৪ বছর রাজ্য শাসন করেছে যে দল, তারাই এখন অস্তিত্ব-সংকটে। সংকট কাটিয়ে আবার ঘুরে দাঁড়াতে পারবে সিপিএম? তা নিয়ে আলোচনা হলো রাজ্য সম্মেলনে। উঠে এলো নানান প্রস্তাব।
দিনকয়েক আগে অভিষেক দলের নেতাদের নিয়ে ভার্চুয়াল বৈঠক করেছিলেন। সেখানে তিনি ভুয়া ভোটারের প্রসঙ্গ ছাড়া বলেছেন, রাজ্যের ১৫ থেকে ২০ হাজার বুথে তৃণমূলের সংগঠন দুর্বল। সেগুলো জোরদার করা হচ্ছে। তার বৈঠকে দলের সাসপেন্ড হওয়া নেতা শান্তনু সেনও ছিলেন। অভিষেক বুঝিয়ে দিয়েছেন, দল শাস্তি দিলেও তিনি তার অনুগামীদের ছাড়বেন না।
ভোটপ্রস্তুতিতে নামার পর তৃণমূল নেতৃত্বের বিরোধও বারবার সামনে আসছে। বীরভূমে অনুব্রত বনাম কাজলের লড়াই চলতে থাকায় মমতা বন্দ্যোপাধ্য়ায় নির্দেশ দিয়েছেন দুই নেতাকে মিলেমিশে কাজ করতে হবে। শুধু তো বীরভূম নয়, প্রতিটি জেলায় তৃণমূলের দুইটি থেকে চারটি আলাদা গোষ্ঠী আছে। দলীয় সূত্র জানাচ্ছে, তারা কেউ মমতা বন্দ্যোপাধ্য়ায়ের অনুগত, কেউ বা অভিষেকের অনুগত। তাদেরকে সামলানোর কাজটা সহজ নয়। এখন মুখ্যমন্ত্রী উঠেপড়ে এই কাজে নেমেছেন।
• বিজেপির পরিস্থিতি
বিধানসভা ভোটের আর একবছর বাকি, বিজেপি এখনো জানাতে পারেনি, সুকান্ত মজুমদার রাজ্য সভাপতি থাকবেন, নাকি মোদি-শাহ কোনো নতুন সভাপতি নিয়োগ করবেন। সুকান্ত কেন্দ্রীয় সরকারের মন্ত্রী। বিজেপির ঘোষিত নীতি হলো এক ব্যক্তি এক পদ। সেক্ষেত্রে সুকান্তর জায়গায় নতুন সভাপতি নিয়োগ করা উচিত। কিন্তু কেন্দ্রীয় স্তরে যেমন জে পি নাড্ডা মন্ত্রী হওয়ার পরেও সভাপতি হিসাবে কাজ চালিয়ে যাচ্ছেন, রাজ্যের ক্ষেত্রে সুকান্তও তাই।
বিজেপির অভ্যন্তরে নেতাদের লড়াইও প্রবল। সুকান্ত মজুমদার ও বিরোধী নেতা শুভেন্দু অধিকারীকে তা-ও কালেভদ্রে একসঙ্গে দেখা যায়, কিন্তু সাবেক সভাপতি দিলীপ ঘোষকে কখনোই অন্যদের সঙ্গে দেখা য়ায় না। দলের সাংগঠনিক সম্পাদক অমিতাভ চক্রবর্তীর প্রতাপও এতদিন ছিল খুবই বেশি। এখন তার হাত থেকে ১৮টি সাংগঠনিক জেলা নিয়ে নেয়া হয়েছে।
বিজেপির এই নেতারা একেকজন একেকদিকে চলেন। তার প্রভাব পুরো সংগঠনের উপরে পড়ে বলে দলীয় সূত্র জানাচ্ছে। আর বিজেপি সংগঠনভিত্তিক দল। ফলে নেতাদের ঐক্য না থাকায় সমস্যায় তারা ভুগছে।
দীর্ঘদিন ধরে বিজেপিকে কাছ থেকে দেখেছেন সাংবাদিক শরদ গুপ্তা। তিনি বলেছেন, অন্য রাজ্যেও এই সমস্যা আছে। কিন্তু ভোটের আগে এই অনৈক্য মোদি-শাহ কড়া হাতে দমন ,করেন। কিন্তু পশ্চিমবঙ্গ নিয়ে বিজেপি-র শীর্ষ নেতৃত্বের মধ্যে সবসময়ই একটা আশংকা কাজ করে, সেটা হলো, বিজেপি জিততে না পারলে বামেরা শক্তিশালী হয়ে যেতে পারে। তাই শীর্ষ নেতৃত্বও অনেক সময় অতটা কড়া মনোভাব দেখায় না।
বিজেপি এবারও স্লোগান দিয়েছে, হিন্দু হিন্দু ভাই ভাই, ২০২৬এ বিজেপি-কে চাই’। আগামী ৬ এপ্রিল তারা রাজ্যজুড়ে খুবই ধুমধামের সঙ্গে রামনবমী পালন করার পরিকল্পনা নিয়েছে। গত লোকসভা নির্বাচনে তৃণমূল পেয়েছিল ৪৬ দশমিক দুই শতাংশ এবং বিজেপি পেয়েছিল ৩৯ দশমিক এক শতাংশ ভোট। ফলে চার শতাংশ ভোট তৃণমূলের থেকে ছিনিয়ে নিতে পারলেই মমতা বন্দ্য়োপাধ্য়ায়কে বিপাকে ফেলে দিতে পারে বিজেপি। তাই তাদের মুখে ৭০-৩০ এর অনুসঙ্গ মাঝেমধ্য়েই আসছে। পশ্চিমবঙ্গে মুসলিমদের সংখ্যা ৩০ শতাংশ এবং হিন্দু প্রায় ৭০ শতাংশ। শুভেন্দুর মতো নেতারা ৭০-৩০ নিয়ে প্রায়ই কথা বলছেন।
শুভাশিস জানিয়েছেন, গত লোকসভা নির্বাচনে রাজ্যের একশর বেশি পুরসভায় বিজেপি ভোটপ্রাপ্তির নিরিখে তৃণমূলের থেকে এগিয়েছিল। ফলে তৃণমূলের একটা চিন্তা তো আছেই।
• সিপিএম যা করছে
কিছুদিন আগেই সিপিএমের রাজ্য সম্মেলন শেষ হলো। মহম্মদ সেলিম আবার রাজ্য সম্পাদক হয়েছেন। জেলা কমিটির নির্বাচন হয়েছে। নতুন মুখ ও তরুণদের গুরুত্ব দেয়ার নীতি নেয়ার সিদ্ধান্ত হয়েছে। এই প্রথম সিপিএমের কোনো বৈঠকে রামকৃষ্ণ পরমহংসের ছবি দেখা গেছে। হুগলি ইমামবাড়ার ছবিও সেখানে ঠাঁই পেয়েছিল।
সিপিএম যুক্তি দিয়েছিল, হুগলি জেলার ঐতিহ্য তুলে ধরার সময় তারা এই ছবি দুইটি ব্যবহার করেছে। কিন্তু দলের বৈঠকে এতদিন ধর্মীয় বিষয়, ছবিকে পরিহার করে চলা সিপিএম কেন মতবদল করলো তা নিয়ে সংবাদমাধ্যমে প্রচুর আলোচনা হয়েছে।
কেন্দ্রীয় স্তরে সমন্বয়ক প্রকাশ কারাটসহ অন্য নেতারা বারবার করে একটা কথা বলেছেন, রাস্তায় নেমে আন্দোলন করতে হবে। না হলে দল সাফল্য পাবে না। এটাও দাবি করা হয়েছে, সিপিএম সম্প্রতি আরজি কর থেকে শুরু করে যাদবপুর পর্যন্ত বিভিন্ন আন্দোলনে প্রবলভাবে থেকেছে। ভবিষ্যতে আরো জোরদার আন্দোলন করা হবে। সেই সঙ্গে ঠিক হয়েছে, প্রার্থী করার ক্ষেত্রে কম বয়সীদের গুরুত্ব দেয়া হবে। গত লোকসভা নির্বাচনেও তা দেয়া হয়েছিল।
আশিস মনে করেন, আন্দোলনের মধ্যে দিয়েই বামেরা জনপ্রিয়তা পেয়েছে এবং ক্ষমতায় এসেছে। কিন্তু সেই আন্দোলন ছিল নাছোড়, লাগাতার আন্দোলন। আরজি করের ওই ভয়াবহ ঘটনার পর প্রবল জনসমর্থন পেয়েও তারা আন্দোলনকে সেই জায়গায় নিয়ে যেতে পারেনি। বরং সরকার সেই আন্দোলনকে নিস্প্রভ করে দিতে পেরেছে।
আশিস বলেছেন, রাজ্যের মানুষ চাকরি পান না, শিল্প নেই, দুর্নীতির ভয়ংকর অভিযোগ আছে, অথচ বামেরা দীর্ঘস্থায়ী কোনো আন্দোলন গড়ে তুলতে পারছেন না। তারা কেবল সামাজিক মাধ্যমে সক্রিয় থেকে সংবাদমাধ্যমে বাইট দিয়ে দায় সারছেন। কৃষক, শ্রমিকসহ কোনো ফ্রন্টেই তারা কিছু করে উঠতে পারছেন না।
• কংগ্রেসের প্রস্তুতি
গত লোকসভা নির্বাচনে রাজ্যে কংগ্রেসের ভোট ছিল চার দশমিক সাত শতাংশ। অধীর চৌধুরীর মতো প্রার্থী পর্যন্ত জিততে পারেননি। তারপর অধীর চৌধুরীকে সরিয়ে রাজ্য সভাপতি করা হয়েছে তুলনায় অনেক লাইটওয়েট নেতা শুভঙ্কর সরকারকে। অধীর চৌধুরী বহরমপুরে মাটি আঁকড়ে পড়ে আছেন। তিনি তার জমি পুনরুদ্ধার করার চেষ্টা করছেন। শুভঙ্কর সরকার মাঝেমধ্যে কলকাতা ও জেলায় বিক্ষোভ দেখাচ্ছেন।
কিন্তু কংগ্রেস হাইকম্যান্ড এখনো পর্যন্ত নির্বাচনী প্রস্তুতি নিয়ে কোনো বৈঠক করেনি। তারা গত লোকসভা নির্বাচনের মতো বামেদের সঙ্গে জোট করে ভোটে যেতে চায়, না কি একলা লড়বে, সেটাও জানায়নি। সংসদে তারা তৃণমূলের সঙ্গে সহযোগিতার ভিত্তিতে চলছে.
এমনিতে কংগ্রেসে ভেটের মাস তিনেক আগে প্রস্তুতি শুরু হয়। ফলে এখনো রাজ্যের ভোট নিয়ে কংগ্রেসের কেন্দ্রীয় নেতৃত্বের মধ্যে খুব একটা হেলদোল দেখা যাচ্ছে না।